খুলনা : সর্বক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন খুলনা শহরের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা। নানাবিধ সমস্যার যাতাকলে পিষ্ট হয়ে থমকে যাওয়ার পথে তাদের জীবনযাত্রা। সমস্যার মধ্যে রয়েছে স্বল্প আয়, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধা, অর্থাভাবে ছোট্ট ঘরে একই সঙ্গে বসবাস। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ওই সম্প্রদায়ের লোকজন।
পূর্বপুরুষের হাত ধরেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকাজে নিয়োজিতরা হরিজন সম্প্রদায়। পর্যায়ক্রমে ইংরেজ এবং পরে ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানÑ যুগে যুগে শাসক বদল হলেও হরিজনদের কাজের ধরণ বদলায়নি। এতে এ সম্প্রদায়ভুক্ত লোকরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকাজে নিয়োজিত থেকে একটি জাতি হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় শুরু করে বসবাস।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা ময়লাপোতা হরিজন কলোনী, পুলিশ লাইন, ৭নং ঘাট গ্রীন লাইন হরিজন কলোনী, রেলওয়ে হাসপাতাল রোড, সদর হাসপাতাল রোড, দৌলতপুরের হরিজন কলোনীতে হরিজনদের বাস। শুধুমাত্র সোনাডাঙ্গা ময়লাপোতা হরিজন কলোনীতে ১৪০ পরিবারে সহস্রাধিক হরিজনের বসবাস।
সরেজমিনে গতকাল বৃহস্পতিবার সোনাডাঙ্গা ময়লাপোতা হরিজন কলোনীতে গিয়ে জানা যায়, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব জমিতে টিনের ছাউনি-বেড়ার একটি ঘর তুলে পরিবার-পরিজন নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। চারপাশে কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। উন্মুক্ত প্রবেশ পথ। ১৪০টি পরিবারের জন্য মাত্র ১৯টি টয়লেট, নলকূপ রয়েছে ৯টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়াও সেখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত নয়। ফলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার শিকার হন সহস্রাধিক মানুষ।
একাধিক হরিজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করায় নিজ ধর্মের অন্য জাতের লোকেরাও তাদের দেখে ভিন্ন চোঁখে। ফলে এ সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজ ধর্মের মধ্যেও অন্য জাতের লোকেদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না। অন্য সবার মতো তারা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। স্বল্প আয় বিধায় ছোট্ট একটি ঘরে পরিবারের ৫-১০ জন্য সদস্য নিয়ে তাদের বাস।
তারা আরও জানান, কর্মের অভাবে সিংহভাগ হরিজন এখন কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কারণ তাদের পেশায় এখন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা অংশ নেওয়ায় কর্ম সংকটে পড়েছেন তারা। ফলে তাদেরও ঝুঁকতে হচ্ছে ভিন্ন পেশায়। কিন্তু হরিজন বলে সব কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পান না তারা। এছাড়া গরীব এসব শিশুরা অর্থাভাবে পান না উচ্চ শিক্ষা। হরিজন শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সেখানে এনজিও থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে একটি ‘দলিত স্কুল’। সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার পর প্রাথমিক স্তর পর করেই অনেকেই ঝুঁকে পরে তাদের বংশীয় পেশায়। ফলে মাধ্যমিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয় তাদের শিশুরা।
হরিজন সম্প্রদায়ের নেতা রাজু দাশ দক্ষিণাঞ্চলকে বলেন, ‘সমাজে আমরা অবহেলা শিকার। আমরা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী বিধায় অনেকেই আড় চোঁখে দেখেন। নিজ ধর্মের লোকেরা কটু দৃষ্টিতে দেখায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও ভিন্ন চোঁখে দেখে। দীর্ঘ ২৪ বছর আমি খুলনা সিটি কর্পোরেশনে মাস্টার রোলে কাজ করছি। চাকরী স্থায়ী না হওয়ায় স্বল্প বেতনে সংসার চালানো কষ্টকর হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছেন হরিজনরা। কিন্তু বর্তমানে অন্য ধর্মের লোকেরা এ পদে নিয়োগ নেওয়ায় আমাদের কর্মহীন হতে হচ্ছে। সবক্ষেত্রে হরিজনদের অংশগ্রহণে বাঁধা দূর করতে তিনি সরকারের জোড়ালো ভূমিকা প্রয়োজন বলে জানান।’