কামরুল হোসেন মনি: নগরীর কথা নামক মাদকাসক্ত চিকিৎসা ও সহায়তা কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্স এর জন্য আবেদনের ওপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিকে এখনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে বিভিন্ন সময় মাদকাসক্তদের চিকিৎসার নামে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানে নেই সার্বক্ষণিক কোন চিকিৎসক, নেই পরিবেশ। কোন কিছুর নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই নিয়ম বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
এ ব্যাপারে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় এর উপ-পরিচালক মোঃ রাশেদুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, কথা মাদক নিরাময় চিকিৎসা কেন্দ্রেটি অনুমতি পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে। তাদের আবেদনের ওপর ভিত্তি করেই, তদন্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হবে। আমাদের শর্ত অনুযায়ী যদি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা না করে সেক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানকে কোনভাবেই লাইসেন্স প্রদান করা হবে না।
এ ব্যাপারে কথা মাদকাসক্ত নিরাময় চিকিৎসা কেন্দ্রের নিজেকে একজন পরিচালক দাবি করে তসলিম আরিফ সোহান এ প্রতিবেদককে বলেন, আপনাকে কেন তথ্য দেবো। কোন তথ্য দিতে পারবো না। তথ্য দেবো মাদকদ্রব্য কর্তৃপক্ষকে। নিয়মিত চিকিৎসক থাকে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন উত্তর দিতে রাজি না হয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এছাড়া রোগীদের বিস্তারিত তালিকা ও কেস স্টাডি তথ্য বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোন তথ্য দিতে পারবো না।
এ ব্যাপারে কথা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন শামীম সার্বিক বিষয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, নিয়ম অনুযায়ীই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা হচ্ছে। লাইসেন্স এর জন্য আবেদন করা হয়েছে, এখনো পাইনি। চিকিৎসক সার্বক্ষণিক আছে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে পুনরায় অফিসে আসতে বলেন।
এ ব্যাপারে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ডাঃ শিহাব শাহরিয়া নামে তার জানা মতে কোন ডাক্তার আছে কি না জানা নেই। তবে খান শাহরিয়া নামে একজন ইএমও ডাক্তার আছেন। অফিস চলাকালীন বিষয়টি তিনি জানাতে পারবেন ওই নামে কোন ডাক্তার আছে কি না।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর মহানগরীর ১৮, সামসুর রহমান রোডে রাজিয়া মঞ্জিলের দ্বিতল ভবনে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি ‘‘মাদক ছাড়া বাঁচবো, সুন্দর জীবন গড়বো’’ স্লোগান নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অফিসে ঢুকতেই চোখে পড়ে নেমপ্লেটে ডাঃ শিহাব শাহারিয়া, এমবিবিএস, খুলনা মেডিকেল কলেজ। প্রতিষ্ঠানে ভেতরে অফিস কক্ষে বসেই প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বিষয়গুলো জানতে চাওয়া হয়। ওই সময় বাপ্পি ও খলিল এরা দুজনই রিকভারী হিসেবে দায়িত্বে আছেন। তারা একজন বলেন, সন্ধ্যায় ডাক্তার আসেন অন্য জন বলেন সপ্তাহ একবার ডাক্তার আছেন। তবে কোন নার্স বা সেবিকা, সার্বক্ষণিক চিকিৎসক নেই। কোন নার্স বা সেবিকা থাকার বিষয়টি জানতে চাইলে তারা কোন উত্তর না দিয়েই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানকে ফোনে ধরিয়ে দেন। তিনি বসতে বলেন। এসময় তিনি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বলেন, এদের চেনেন নাকি, তারা আমার নিকটজন। এসময়ের মধ্যে তসলিম আরিফ সোহান নিজেকে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক দাবি করে অফিসে এসে উত্তেজিত কন্ঠে সাংবাদিকদের আগমনের কারণ জানতে চান। তার কাছে রোগীদের বিস্তারিত তালিকা ও কেস স্টাডি আছে কিনা, ডাক্তার, নার্স কজন এবং পরিচালনা কমিটিতে কয়জন? এমন প্রশ্ন করা হলে প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোন তথ্য দিতে পারবোনা।
সম্প্রতি এক ভুক্তভোগীর লোমহর্ষক বর্ণনায় ‘কথা নিরাময় কেন্দ্রের ব্যাপারে নানা অনিয়ম বিষয়ে এ প্রতিবেদকের কাছে একটি রের্কড রয়েছে। এতে মাদকাসক্তদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ধরেন তিনি। ওই ব্যক্তির ভাষ্য মতে, মাদকাসক্ত চিকিৎসা ও সহায়তা কেন্দ্রটি একটি টর্চার সেল হিসেবে কাজ করে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে রোগীর ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। মাদকাসক্ত রোগী একসঙ্গে ভর্তি করে বছরের পর বছর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতো করে সেবা দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেয় স্বজনদের অর্থ-কড়ি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই সেখানে। ফলে ছারপোকার কামড়ে অনেক রোগীর হাত-পায়ে চর্মরোগের সৃষ্টি হয়েছে। মাদকাসক্ত না হয়েও আটকে রাখারও অভিযোগ রয়েছে। এ কেন্দ্রে নির্যাতনের সময় বিকট শব্দে গান বাজানো হয়। সম্পদের উত্তরাধিকারী মাদক গ্রহণ করেনা অথচ তাকে মাদকাসক্ত বানিয়ে দেওয়া হয়। নেপথ্যে কাজ করে সম্পদশালীর জমি ভোগ দখল ও সম্পদ লুন্ঠনের। এজন্য মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এ কেন্দ্রের রিকভারিরা কৌশলে অপহরণ করে আটকে রাখে বছরের পর বছর। এমনই একজন হতভাগা যার নামের প্রথম অক্ষর ‘লা’ তিনি কোন নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যাবহার করেননা, অথচ তার টাকা পয়সা ও সম্পদ ভাগিয়ে নিতে তার মামাতো ভাই ‘কথা’ নামক ওই মাদকসক্ত চিকিৎসা ও সহায়তা কেন্দ্রের সদস্যদের মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে, দীর্ঘদিন নির্যাতন করে মানসিক রোগীতে পরিণত করেছে। শুধু ‘লা’ই না তার মতো ৩০-৩৫ জন সেখানে বন্দী জীবনযাপন করছে। কথা নিরাময় কেন্দ্রে বিত্তশালী পরিবারের সন্তানকে বেশি নির্যাতন করে মোটা অঙ্কের টাকার জন্য। নির্যাতন শুরু হয় বাথরুমে সাতদিন আটকে রাখার মাধমে। এরপর চলে কাকরা বন্দ নির্যাতন, পায়ের তলে লাঠি মালিশ ও যীশু খ্রীস্টের শূল নির্যাতন, খাবার বন্দসহ নানা ধরনের নির্যাতন।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় সূত্র মতে, বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার জন্য সরকারি শর্তাবলীর মধ্যে রয়েছে- আবাসিক এলাকায় পাকা বাড়ি বা ভবন, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। একজন রোগীর জন্য কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। অন্যদিকে প্রতি ১০ বেডের জন্য পৃথক একটি টয়লেট, বাথরুম, বিশুদ্ধ পানি, অন্যান্য সুব্যবস্থা এবং খ-কালীন বা সার্বক্ষণিক একজন মনোচিকিৎসক, সার্বক্ষণিক একজন ডাক্তার, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স, একজন সুইপার বা আয়া এবং জীবন রক্ষাকারী উপকরণ ও অত্যাবশ্যক ওষুধ থাকতে হবে। এছাড়া মাদকাসক্ত ব্যক্তির রক্ত, কফ, মলমূত্র ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত যে কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা থাকতে হবে। কেন্দ্রে একক বা দলগত পরামর্শক এবং মানসিক বিনোদনের জন্য অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন ও কাউন্সেলিংয়ের জন্য ২০ জনের উপযোগী একটি শ্রেণিকক্ষ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ওই সব নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না, মানছেন না সরকারি ওই সব শর্তগুলো। অথচ প্রকাশ্যে চলছে মাদক নিরাময় নামের এ রমরমা ব্যবসা।