কামরুল হোসেন মনি : রূপা আক্তার (ছদ্মনাম)। মেয়েটির বাবা নেই। নগরীর খালিশপুর এলাকায় বসবাস করে। মুজগুন্নীর স্থানীয় সুদর্শন এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়। প্রণয়ের পর ছেলেটি তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দৈহিক মেলামেশা শুরু করে। এক পর্যায়ে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এরপর থেকে ছেলেটি তাকে এড়িয়ে চলতে থাকে। বিষয়টি স্থানীয় কাউন্সিলরকে অভিযোগ দিয়েও সঠিক বিচার পায়নি, উল্টো মেয়ের ওপর আসে হুমকি ধামকি। রূপার অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে ভিকটিম সাপোর্টে নিয়ে আসা হয়। এরপর সেখানে তাকে আশ্রয়সহ আইনের সহায়তা থেকে শুরু করে তার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করা হয়। প্রতারক প্রেমিকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় বর্তমানে ছেলেটি জেল হাজতে রয়েছে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে নারীর অবস্থান অনেক ওপরে উঠে এলেও ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে রূপার মতো অনেকেরই। যৌতুকের দাবি আর বহু বিবাহের মতো ঘটনায় নির্যাতন নেমে আসে নারীর ওপর। বরং আধুনিক জটিল সমাজে এ নির্যাতন-নিপীড়ন হয়ে উঠেছে বহুমাত্রিক। এসব ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচার দাবি বা চাওয়ার মতো অবস্থানে নেই তারা। আবার যারা বিচার চাইতে যাচ্ছেন, তারাও নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারী নির্যাতনের মতোই দিন দিন বাড়ছে শিশু নির্যাতন।
নারী ও শিশু নানান ধরনের নির্যাতনের শিকার ও হারিয়ে যাওয়া শিশু ও নির্যাতিতদের পাশে রয়েছে নগরীর খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। অভিযোগ পাওয়ামাত্র অসহায় নারী ও শিশুদের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা দিয়ে তারা আলোর পথ দেখাচ্ছেন। সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে গ্রহণ করছে কার্যকর পদক্ষেপ। ঠিকানাবিহীন শিশুকে পৌঁছে দিচ্ছে বাবা-মায়ের কোলে। কোনো বিরতি ছাড়াই ২৪ ঘন্টা সেবা প্রদান করছে এ কেন্দ্রটি।
কেএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) ও কেএমপি ভিকটিম সাপোর্টের ইনচার্জ সোনালী সেন বলেন, নির্যাতিত নারী ও শিশুদের জন্য এ কেন্দ্রটি ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। অভিযোগ হেলপ লাইন ‘৯৯৯’ সার্ভিস এর মাধ্যমে অনেক নির্যাতিত নারী অভিযোগ দিচ্ছেন। এখানে ১৫ জন মহিলা পুলিশ রয়েছেন। এর মধ্যে ইন্সপেক্টর থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত রয়েছেন। ভিকটিমের জন্য নিয়মিত চিকিৎসা ও কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা টিমওয়ার্কের মতো কাজ করি। তিনি বলেন, দিনকে দিন নারী ও শিশু নির্যাতনের বিভিন্ন অভিযোগ আমাদের অভিযোগ হেলপ লাইনের মাধ্যমে অভিযোগ দিচ্ছেন। সেখানে আমরা সাথে সাথে মুভ করি। এ সংস্থার নিজস্ব যানবাহন না থাকায় থানা থেকে গাড়ি ধার করে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে হয়। তিনি বলেন, ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে যৌতুকের কারণে নির্যাতিত নারীরা বেশি অভিযোগ নিয়ে আসেন। যখন আমাদের কাছে কোন ভিকটিম অভিযোগ নিয়ে আসেন, তখন তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে খাতায় তার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করি। অধিকাংশ ভিকটিমই সংসার টিকিয়ে রাখতে মীমাংসার পথে যেতে চায়। তখন আমরা উভয় পক্ষকে ডেকে তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করি। এ সময় কাউন্সিলর, ডিউটি অফিসার ও আমি উপস্থিত থাকি। এছাড়া, হারানো নারী ও শিশুদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত এখানে আশ্রয়ের বিষয়টিও আমরা নিশ্চিত করি। তবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ মারাত্মক ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। বেড সংখ্যা বৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। অনেক সময় নির্যাতিত নারী অভিযোগ করবে সে পয়সা-কড়ি থাকে না। এ জন্য টোল ফ্রি অভিযোগ হেলপ লাইন চালুর উদ্যোগের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা চলছে।
কেএমপি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর নগরীর সোনাডাঙ্গা মডেল থানার পাশে কেএমপি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এ পর্যন্ত সেবা প্রাপ্ত ভিকটিমের সংখ্যা ২৩৬ জন। এর মধ্যে মেয়ে শিশু ভিকটিমের সংখ্যা ১১৯ জন, নারী ভিকটিমের সংখ্যা ৭৮ ও ছেলে ভিকটিমের সংখ্যা ৩৯ জন। এর মধ্যে যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ নানা ধরনের মোট ৭৮টি মামলা দায়ের করা হয়।
ওই সূত্র মতে, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের থাকার জন্য আটটি বেড রয়েছে, যার মধ্যে নারীর বেড সংখ্যা ৬টি। এখানে ৫ দিন পর্যন্ত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পুলিশের পাশাপাশি ৫টি এনজিও আইনী সহায়তাসহ অন্যান্য কাজ করছে। নতুন করে এ বছর আরও দুইটি এনজিও যোগ হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মেরিস্টপ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, মহিলা আইনজীবী সমিতি, অপরাজেয় বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ডভিশন ও জেজেএস।
বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার খুলনা কো-অডিনেটর অ্যাডঃ মোমিনুল ইসলাম বলেন, কেএমপি ভিকটিম সাপোর্ট এর কার্যক্রম সম্পর্কে আরো প্রচারণা প্রয়োজন। দিনকে দিন যেভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই জন্য বেড সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসনের প্রয়োজন। এছাড়া নির্যাতিতদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির ব্যবস্থাও প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
এ ব্যাপারে কেএমপি ভিকটিম সাপোর্ট এর ইন্সপেক্টর ফারাজানা বলেন, পারিবারিক নির্যাতন সহিংসতার অভিযোগবিষয়ক একটি অভিযোগ হেলপ লাইন খোলা হয়েছে। ভুক্তভোগী নারীরা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে অভিযোগ দায়ের করছেন। যা গত তিন মাসে ১শ’র ওপরে অভিযোগ জমা পড়েছে। নতুন এ অভিযোগ হেলপ লাইন স্থানীয় একটি চ্যানেলে নিয়মিত প্রচারণা থাকায় ব্যাপক সাড়া পড়েছে।