আহমেদ ফরিদ, রাবি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া ভর্তিচ্ছুদের থেকে মেস মালিকদের চাঁদাবাজি থামছেই না। টাকা আদায় করার জন্য শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থী-ভর্তিচ্ছুরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর মন্ডলের মোড়ের ওকেডি ছাত্রাবাস। নাম প্রকাশ না করার স্বর্তে মেসের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘মেসে মালিক আগে থেকে জনপ্রতি টাকা দাবি করেছিলো। কয়েকজন বর্ডার টাকা দিতে অস্বীকার করে এবং তারা এর প্রতিবাদ করে। গত রাতে মেসে মারিক স্থানীয় ২০ থেকে ২৫ জন বখাটে সঙ্গে করে মেসে হাজির হয়। মেইনগেইট লক করে চলে ধমকাধমকি। যারা টাকা দিতে অস্বীকার করে, তাদের স্থানীয় দলবল দিয়ে মার খাওয়ানোর ভয় দেখানো হয়। এটি বড়ই অমানবিক।’
মুঠোফোনে ঘটনার সত্যতা মেস মালিকরে কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আগে আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে। এরপর আমরা আত্মীয় স্বজন ডেকে তাদেরকে বলেছি। তাদের সাথে কোন খারাপ আচরণ করা হয়নি।
গত বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে প্রক্টরিয়াল বডি ও রাজশাহী মেস মালিক সমিতির ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের বিষয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানবিক বিবেচনায় প্রতিজন ভর্তিচ্ছুর কাছ থেকে সর্বোচ্চ একবার ১০০ টাকা নিতে পারবে মেস মালিকরা। এছাড়া মেস মালিকরা যেন অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে না পারে সেজন্য মেস এলাকা গুলোতে মেস মালিক সমিতির চারটি মনিটরিং সেল ও একটি হেল্প ডেস্ক কাজ করবে বলে জানা যায়।
নগরীর বিনোদপুর, কাজলা, তালাইমারি এলাকার কয়েকটি মেসের আবাসিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েকটি মেস প্রশাসন ও মেস মালিক সমিতির নির্দেশ মেনে চলছে। প্রতি জনের কাছে একবার সর্বোচ্চ ১০০ টাকা নেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ মেস মালিক তা মানছে না। প্রত্যেক পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছে থেকে প্রতি রাতের জন্য ১০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা নিচ্ছে মেস মালিকরা। শিক্ষার্থীরা বিষয়টি প্রতিবাদ করলে মেস মাকিলরা বলছেন, পুলিশ ও মেস মালিক সমিতি তাদের টাকা নিতে বলেছে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বিনোদপুরের হোয়াইট হাউজ মেসের মালিকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করে বলেন, কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই এই মেস মালিক ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে ইচ্ছা মত টাকা নিচ্ছে। আমরা ভয়ে কিছু বলতে পারছি না। পরে আমাদেরই থাকার সমস্যা হয়।
অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রীনিবাসের মালিক মিথুন বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়নি। মেসের সবাইকে পরীক্ষার্থীদের নিয়ে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। বিভিন্নভাবে নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে।
জানতে চাইলে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের কোন নির্দেশনা পুলিশ মেস মালিকদের দেয় নি। তবে নিরাপত্তার জন্য মেসে অবস্থানকারী পরীক্ষার্থীর পরিচয় লিখে রাখার নির্দেশ দিয়েছি। ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে পুলিশ কেন বলতে যাবে? সেটা মেস মালিকদের ব্যাপার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিনোদপুর এলাকার রমেশা ছাত্রী মহল, তালাইমারি এলাকার বিসমিল্লাহ ছাত্রীনিবাস, নুপুর ছাত্রীনিবাস, উপর ভদ্রা এলাকার শিরিন লজ ছাত্রী নিবাসসহ কয়েকটি মেস পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি রাতের জন্য ২০০ টাকা করে নিচ্ছে। এছাড়া বিনোদপুর এলাকার পাটোয়ারী টাওয়ার ছাত্রীনিবাস, গফুর মঞ্জিল, মাহিন ছাত্রীনিবাস, দৃষ্টি ছাত্রীনিবাস, অপূর্ব ছাত্রীনিবাস, এনএন ছাত্রাবাস, শাহাবুদ্দিন ছাত্রবাস, স্বপ্নীল ছাত্রাবাসসহ বেশ কয়েকটি মেস প্রতি রাতের জন্য ১০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। বিনোদপুরের ইখওয়ান ছাত্রীনিবাস প্রতি রাতের জন্য ১৫০ টাকা নিচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, ছাত্রী মেসের মালিকরা সবচেয়ে বেশি অর্থ নিচ্ছে। কারণ ছেলেরা মেস মালিকদের সঙ্গে দেন দরবার করতে পারলেও মেয়েরা মালিকদের কথার বাহিরে যেতে পারে না। মেয়েরা প্রতিবাদ করলে তাদের মেস থেকে বাহির করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। তাই অধিকাংশ ছাত্রীনিবাসের শিক্ষার্থীরা মালিকদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হয়।
জানতে চাইলে পাটোয়ারী টাওয়ারের মালিক হাবিবা আক্তার বলেন, কোটি কোটি টাকা দিয়ে মেস বানিয়েছি সেখানে ১০০ টাকার জন্য আমি মরে যাবো? আমি ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিরাতের জন্য ১০০ টাকা করে নিচ্ছি। শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর মেস মালিক সমিতি কত টাকা নিতে হবে ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু সমিতি আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলে নি।
নগরীর উপর ভদ্রা এলাকার শিরিন লজ ছাত্রীনিবাস প্রতি রাতের জন্য ২০০ টাকা করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছাত্রীনিবাসের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, ভর্তিচ্ছু রাখার জন্য মেসটির মালিক রাবি প্রশাসন ও মেস মালিক সমিতির নির্ধারিত অর্থের অতিরিক্ত দাবি করেছে। মেসটির মালিক তাদের বলেন, এই সিদ্ধান্ত বড় বড় মেসগুলোর জন্য, তার মেসের জন্য নয়। এ বিষয়ে জানতে শিরিন লজের মালিক বা মেসের ম্যানেজার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে মন্ডলের মোড় এলাকার গফুর মঞ্জিলে ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে ২০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। অভিযোগ আছে, মেসে যেসব পরীক্ষার্থীর পরিচিত কেউ নেই তাদের কাছ থেকে পুরো এক মাসের ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে গফুর মঞ্জিলের মালিক অমিত হাসান বলেন, পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে এক মাসের ভাড়া নেয়া হচ্ছে এটা সত্য নয়। অনেকে আগে থেকেই সিট নিয়ে রেখেছেন তাদের কাছ থেকে শুধু অক্টোবর মাসের ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এছাড়া পরীক্ষার্থীদের কাছে এক রাত থাকলে ১০০টাকা আর এক রাতের বেশি যত দিন থাক ২০০ টাকা নেয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে রাজশাহী মেস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইসমাঈল হোসেন বলেন, আমি ইতোমধ্যে রমেশা মহল, পাটোয়ারী টাওয়ারসহ সব মেসে বলে এসেছি যেন ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ একবার ১০০ টাকার বেশি না নেয়া হয়। রমেশা মহল, গফুর মঞ্জিলসহ কয়েকটি মেসের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ পেয়েছি। এভাবে এত বেশি টাকা নেয়া আসলেই অমানবিক কাজ। আমি আবারও তাদের বলবো তারা যেন নির্ধারিত অর্থের বেশি না নেয়।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. লুতফর রহমান বলেন, ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মেস মালিকরা অতিরিক্ত অর্থ যেন না নিতে পারে সেজন্য মালিক সমিতিকে ডেকে কথা বলেছি।