নিজস্ব প্রতিবেদকঃ নগরীর শীতলাবাড়ী মন্দিরে অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃত্যু রহস্য এক মাসেও উদঘাটন হয়নি। এ মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে চলছে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে হাসপাতালের চিকিৎসক ও পুলিশের বক্তব্য এবং মন্দির কতৃর্পক্ষের বক্তব্যের মধ্যে ভিন্নতা থাকায় তার মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে ঘটনার সময়ে মন্দিরের কেয়ার-টেকার দিপংকর এবং পুরোহিত রনোজিত চক্রবর্তীসহ একাধিক মানুষ উপস্থিত থাকলেও তারা কেউই দূর্ঘটনার বিষয়ে কোন কিছুই জানে না বা কেউই কিছুই দেখেনি বলে জানিয়েছে। একজন মানুষের মৃত্যুর মত একটি ঘটনার বিষয়ে মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দ কোন পদক্ষেপ না নিয়ে মন্দিরের কেয়ার-টেকার দিপংকরকে দিয়ে থানায় জিডি করার ঘটনাও সমালোচনার সৃষ্টি করেছে।এছাড়া মন্দিরের মধ্যে তার মৃত্যু হলেও সঠিক নাম-পরিচয় সন্ধান না করেই সৎকার করার ঘটনায় স্থানীয়দের মনে সন্দেহের ধুম্রজাল তৈরী হয়েছে। অনেকেই মন্দিরের মধ্যে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির মৃত্যু স্রেফ দূর্ঘটনা নাকি হত্যা এমনও প্রশ্ন তুলেছেন। মন্দির সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি ও স্থানীয়রা বলছেন, সঠিকভাবে তদন্ত করলে অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃত্যুর সত্যিকার রহস্য উদঘাটন হতে পারে। যার মধ্য দিয়ে বের হতে পারে আসলেই সেটি দূর্ঘটনা নাকি হত্যা করা হয়েছে। গত প্রায় ১৫দিন যাবৎ শতিলাবাড়ি মন্দিরের মধ্যে অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, গত ০৮অক্টোবর অজ্ঞাত বয়স্ক এক ব্যক্তি খুলনা নগরীর শীতলাবাড়ি মন্দিরে আসে। তিনি সেখানে রাতে থাকতে চায়। কিন্তু মন্দিরের পুরোহিতসহ অন্যরা রাতে মন্দিরে অবস্থান করা যাবে না একথা বলে তাকে ইসকন মন্দিরে যাওয়ার জন্য বলে। পরে অনেক রাতে ওই ব্যক্তি মন্দির থেকে বের হয়ে যায়। পরদিন ০৯অক্টোবর শনিবার সকালে ওই ব্যক্তি আবারও শতিলাবড়ি মন্দিরে আসে। এ সময় মন্দিরের মধ্যে অনেকেই ছিলেন। কিছুক্ষন পরে দুপুরের দিকে মন্দিরের ভেতরে নির্মান কাজ চলা দূর্গা মন্দিরের পিছনে পুকুর পাড়ে ওই ব্যক্তিকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তখন কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে এবং মন্দিরের কেয়ার-টেকার দিপংকর ও অপূর্ব জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষনা করে।এরপর লাশের ময়না তদন্তের জন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়। এ সময় মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে সদর থানা পুলিশকে অবহিত করা হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে সুরতহাল প্রতিবেদন করে। পরে মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দ কেউ দায়িত্ব না নিয়ে কেয়ার-টেকার দিপংকরকে দিয়ে খুলনা সদর থানায় একটি অপমৃতূ মামলা(নং-১৯, তারিখ-০৯-১০-২০২২) করানো হয়।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীতলাবাড়ি মন্দির সংশ্লিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি জানান, গত ০৯ অক্টোবর সকালে ওই ব্যক্তি যখন শীতলাবাড়ি মন্দিরে আসে তখন মন্দিরের সভাপতি শ্যামা প্রসাদ কর্মকার, সাধারন সম্পাদক বিজয় কৃষ্ণ ঘোষ, পুরোহিত রনোজিত চক্রবর্তী, কেয়ার-টেকার দিপংকরসহ কমিটির অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তখন ওই ব্যক্তির সাথে মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ ও থাকার বিষয় নিয়ে সাধারন সম্পাদক ও সভাপতির কথা কাটাকাটি হয়।এক পর্যায়ে সাধারন সম্পাদক তাকে ধাক্কা ও চড় মেরে বের হয়ে যেতে বলেন। কিন্তু তারপরেও ওই ব্যক্তি চলে না যাওয়ায় পরে তাকে বের করে দেয়ার কথা বলে মন্দিরের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক মন্দির থেকে চলে যান। এরপর মন্দিরের পুরোহিত রনোজিত চক্রবর্তী ও কেয়ার-টেকার দিপংকরসহ কয়েকজন তাকে বের করার চেষ্টা করলেও সে বের হয়ে যায়নি।পরবর্তীতে দুপুর দুটোর দিকে নির্মানাধীন দূর্গা মন্দিরের পিছনের পুকুর পাড়ে তাকে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
মন্দিরের কেয়ার-টেকার দিপংকর জানান, ওই ব্যক্তি ০৮অক্টোবর শুক্রবারও মন্দিরে এসেছিল। সে রাতে থাকতে চাইলে তাকে ইসকন মন্দিরে যাওয়ার কথা বলে রিকসায় উঠিয়ে দেয়া হয়। পরে শনিবারেও সে মন্দিরের ভেতর আসে। এ সময় মন্দিরের কর্মকর্তারাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তখন তাকে বের হয়ে যেতে বলা হলেও সে বাইরে না গিয়ে পুকুরের দিকে চলে যায়। দুপুরে মন্দিরের গেইট বন্ধ করার পর নির্মান শ্রমিকরা ওই ব্যক্তিকে পড়ে থাকতে দেখে ডাক-চিৎকার দেয়। এ সময় সে (দিপংকর)সহ পুরোহিত রনোজিত ও মন্দিরের ম্যাচের অপূর্ব এবং আরও কয়েকজন এসে তাকে উদ্ধার করে মন্দিরের কর্মকর্তাদের নির্দেশে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষনা করে। পরে থানা পুলিশ গিয়ে লাশ নিয়ে ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করে। সে আরও জানায়, নির্মানাধীন দূর্গা মন্দিরের আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিদ্যুতের তারে লেগে তার মৃত্যু হয়েছে। এ মৃত্যুর ঘটনায় মন্দিরের কর্মকর্তাদের নির্দেশে খুলনা সদর থানায় একটি সাধারন ডাইরি করি। পরে যা অপমৃত্যু মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। পরবর্তীতে ঘটনার ১০দিন পরে ১৯অক্টোবর শনিবার তাকে রূপসা মহাশ্মশানে দাহ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
মন্দিরের সদস্য অমর দাস জানান, তিনি ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না। ঘটনার কিছুক্ষণ পরে তিনি মন্দিরে যান। তবে তিনি শুনেছেন যে বিদ্যুতের তারে বেধে ওই ব্যক্তি মারা গেছে। মন্দিরের কেয়ার-টেকারকে দিয়ে কেন একজন মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে জিডি/মামলা করা হলো সে প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি মন্দির কমিটির কর্মকর্তারা সঠিকভাবে বলতে পারবেন।
মন্দিরের বিদ্যুতের সকল কাজ করেন বিদ্যুৎ মিস্ত্রি আ: আজিজ। তার ০১৭১২-৬২০৬৪৯নং মোবাইলে কথা বলা হলে তিনি জানান, মন্দিরের বিদ্যুত সংক্রান্ত সকল কাজ তিনি করেন। কিন্তু নির্মানাধীন দূর্গা মন্দিরের বিদ্যুতের সংযোগ তিনি বিচ্ছিন্ন করেননি। একজন মানুষ মারা যাওয়ার পর মন্দির কমিটির কর্মকর্তারা আমাকে ফোন দিলে পরের দিন গিয়ে সিসি ক্যামেরার তার ঝুলে ছিল সেটি অপসারন করে দিয়েছেন। বিস্তারিত আর কিছুই তিনি জানেন না।
খুলনা মেডিকেল কলেজের ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকদের সূত্রে জানা গেছে, নাম-পরিচয় বিহীন যে ব্যক্তিকে আনা হয়েছিল তাকে আমরা পরীক্ষা করেছি। তার ভিসেরা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ভিসেরা রিপোর্ট আসলে সঠিক তথ্য ও কারন জানা যাবে।
খুলনা সদর থানার এসআই বোধন চন্দ্র বিশ্বাস এ প্রতিবেদককে জানান, শীতলাবাড়ি মন্দিরের মধ্যে এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে পড়ে থাকতে দেখে মন্দিরের লোকজন তাকে প্রথমে জেনারেল হাসপাতালে এবং পরে সেখান থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন এবং মৃত্যুর কারন হিসাবে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট উল্লেখ করেছেন। সে কারনে তারাও অপমৃত্যু মামলায় সেটিই লিখেছেন। এ সময় তিনি আরও জানান, মন্দিরের দূর্গা পূজা মন্ডপ সংস্কার হচ্ছে। সেখানে অসাবধানতা বসত: বিদ্যুতায়িত হয়ে যেতে পারে। লোকটি বাথরুমে যাবার পথে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যেতে পারেন। তাকে ওখানেই পড়ে থাকতে দেখেছে সবাই। মৃত ব্যাক্তির ময়না তদন্ত হয়েছে। তার পরিচয় না পাওয়া যাওয়ায় ঘটনার ১০দিন পর শনিবার(১৫অক্টোবর) রূপসা শ্মশানে তার সৎকার করা হয়েছে। ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে নাম-পরিচয় খুজে বের করতে পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক প্রচারসহ বিশেষ কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা বা সে কোন সম্প্রদায়ের মানুষ সেটি নির্ধারন না করে সৎকার করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর দেননি। এছাড়া এই ঘটনায় মন্দির কতৃপক্ষের কোন অবহেলা বা দায়িত্বহীনতা আছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পূর্নাঙ্গ তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।
এ বিষয়ে শীতলাবাড়ী মন্দিরের সভাপতি শ্যামা প্রসাদ কর্মকারের ০১৭১১২৯৫৬৩৭ নাম্বার মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে জানা গেছে সভাপতি ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন। তবে মন্দির কমিটির সাধারন সম্পাদক বিজয় কৃষ্ণ ঘোষ জানান, তিনি আগের দিন ০৮অক্টোবর ওই ব্যক্তি যখন মন্দিরে আসে তখন তিনি জেনেছেন এবং ইসকন মন্দিরে থাকার জন্য বলেছিলেন। তবে শনিবার সকালে যখন ওই ব্যক্তি আসে তখন তিনি মন্দিরে ছিলেন না। পরে তিনি কেয়ার-টেকার দিপংকর ও পুরোহিত রনোজিত চক্রবর্তীর কাছ থেকে মৃত্যুর কথা শুনেছেন। তিনি জানান, ওই ব্যক্তির সাথে তার কোন কথা কাটাকাটি হয়নি বা চড় মারার ঘটনাও ঘটেনি। এটা সম্পূর্নই মিথ্যা। যারা বলছেন তারা সঠিক বলছেন না। তিনি আরও জানান, দুপুরের দিকে ওই ব্যক্তি মন্দিরের নির্মানাধীন ভবনের পিছনের পুকুরের দিকে যেতে গিয়ে লোহার রডে আঘাত লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে মিস্ত্রিসহ অন্যরা দেখতে পেয়ে তাকে উদ্ধার করে। এ সময় কেয়ার-টেকার আমাকে জানালে আমি হাসপাতালে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেই। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তবে চিকিৎসকরা বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যুর কথা বলছেন সে বিষয়ে তিনি জানান, চিকিৎসকরা সঠিক বলছেন না। রডের আঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। পরে সভাপতি শ্যামা প্রসাদ কর্মকার ও আমি দুজনে পুলিশকে খবর দিয়ে পোষ্টর্টেম করার ব্যবস্থা করেছি। ওই ব্যক্তিকে আঘাতের জেরে মৃত্যু হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অসম্ভব তাকে কেউই আঘাত করেনি। তবে বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন না করে বা এলোমেলোভাবে ফেলে রেখে কেন নির্মান কাজ করা হচ্ছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই বিদ্যুত লাইন বিচ্ছিন্ন করেই কাজ করছি। চিকিৎসক ও পুলিশ যেটা বলছে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু হয়েছে কিন্তু তিনি বলছেন রডের আঘাত লেগে মারা গেছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি যেটা বলছি সেটাই সঠিক। মন্দিরের কর্মকর্তারা জিডি বা মামলা না করে কেন কেয়ার-টেকারকে দিয়ে করানো হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এটি সভাপতির সাথে পরার্শ করেই করা হয়েছে। তবে মন্দিরের কর্মকর্তারা করলে ভালো হতো। এটি হয়তো একটা ভুল হয়েছে। অন্যদিকে, নাম-পরিচয় না জেনে কেন রূপসা মহাশ্মশানে সৎকার করা হলো সে বিষয়ে তিনি কোন সঠিক জবাব দিতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, পুলিশ ও সভাপতির নির্দেশেই এটা করা হয়েছে। বিষয়টি সভাপতিই ভালো বলতে পারবেন বলে তিনি জানান।
এদিকে, মন্দির সংশ্লিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি ও স্থানীয়রা শীতলাবাড়ি মন্দিরের মধ্যে একজন ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা সত্যিই কোন দূর্ঘটনা নাকি হত্যা সে বিষয়ে তদন্ত পূর্বক সঠিক তথ্য উদঘাটনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে পুলিশ ও প্রশাসনের উধ্বর্তন কতৃর্পক্ষের কাছে দাবী জানিয়েছেন। যেন এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ভবিষ্যতে আর কোথাও না ঘটে।