১৯১১ সালের ২০ শে জুন, বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুফিয়া কামাল। শামসুর রাহমানের ভাষায়:‘অন্ধকারে যিনি বারবার হেঁটেছেন রাজপথে/জ্বলন্ত মশাল হয়ে নির্ভুল। আজ এই মমতাহীন অন্ধবেলায় তাঁকেই খুঁজে ফেরে শীতার্ত মানুষ কোমল ¯েœহের প্রত্যাশিত ওমের জন্য-তাই স্মৃতিপটে বারবার ‘আলোকিত পদ্মের মতোই ফুটে ওঠে তাঁর মাতৃমুখ।’ সৌম্য-¯িœগ্ধ ‘বাঙালি মাতৃমূর্তি’র প্রতীক যিনি,তাঁর সংগ্রামী রূপের ছবিটি এই রকম:জীবন যে কত বড় এবং তাকে যে সাধনায়,ত্যাগে,সদিচ্ছায়,শ্রমে,অঙ্গীকারে কত সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে নির্মাণ করা যায় তার নজির বেগম সুফিয়া কামাল। যে রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে তাঁর জন্ম ,সেখান থেকে তিনি শুধু উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে বেরিয়ে আসেন নি-দুঃসহ নিগড়ে আবদ্ধ বাঙালি মুসলমান নারীসমাজকে তিনি জাগর-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন,শৃঙ্খলমুক্ত জীবনের স্বাদ দিয়েছেন। রক্ষণশীল ও আভিজাত্যের বৃত্ত ভেঙেই তিনি সাহসী কিন্তু দৃঢ় পদচারণা শুরু করেছিলেন। বৃত্ত যিনি ভাঙতে পারেনÑতিনি আরো বৃত্ত ভাঙার জন্য প্রস্তুতি নেন। সুফিয়া কামালও তাই করেছেন আজীবন। অশুভ,অসন্দুর,অকল্যাণ-এর বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আজীবন সক্রিয় যোদ্ধা। সুফিয়া কামাল যদিও আমাদের নিকট কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত কিন্তু তাঁর প্রথম লেখা ‘সৈনিক বধূ’ নামক ছোটগল্প। গল্পটি ছাপা হয়েছিল বরিশালের ‘তরুণ’ পত্রিকায়,তখন সুফিয়া কামালের বয়স তেরো-চৌদ্দ কি পনের বছর। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে সব সময়ই তিনি পালন করেছেন নির্ভীক দিশারী ভূমিকা। ভাষা আন্দোলন খেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সক্রিয় সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ,রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন,ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং প্রতিবাদ হিসেবে সরকারি খেতাব বর্জন,সত্তরের প্রলয়ংকারী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো,মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনসহ সব কর্মসূচিতে মহিলাদের অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দান-তাঁর সমাজ ও স্বদেশমনস্ক বিবেকি চেতনার স্মারক। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তাঁর কর্মকা- ভিন্ন আঙ্গিকে নতুন মাত্রা পায়।বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে শত সংকটেও তিনি সক্রিয় সাহসী ভূমিকা পালন করে গেছেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত স্বৈর সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম-প্রতিবাদও কখনো থেমে থাকেনি। শুধু আন্দোলন- সংগ্রামেই নয়,প্রগতিশীল সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং এর নেতৃত্ব প্রদানেও তাঁর সময়োপযোগী ভূমিকার কথা স্মরণ করা প্রয়োজন। তাঁর সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার সূচনা হয়েছিল বরিশালে ‘মাতৃমঙ্গল’ এর মাধ্যমে।এই অভিজ্ঞতা আরও গাঢ় হয় রোকেয়ার সান্নিধ্যে এসে তাঁর ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। ১৯৫১ সালে ‘ঢাকা শহর শিশুরক্ষা সমিতি’ ও ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রিয় ‘কচি-কঁচিার মেলা’ তাঁর ঢাকার তারাবাগের বাসার চত্বরে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর উদ্যোগেই ঢাকায় গঠিত হয় ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’(১৯৬০) । রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনেও (১৯৬১) তাঁর সক্রিয় ভূমিকার কথা অজানা নয়্ এ দেশের সুস্থ সংস্কৃতি ধারার বিকাশে ও বাঙালি সংস্কৃতির লালনে ছায়ানটের (১৯৬১) ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উৎসবে তিনি ১৯৬৬ সালে মস্কোয় যান। ১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ আজ এর নাম ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ গঠন তাঁর আরেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।‘রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’ ১৯৮২ কিংবা ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ ১৯৮৮-এর মতো বিপরীত মেরুর প্রতিষ্ঠানের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালনের ভেতর দিয়ে তাঁর মন-মানস,চিন্তা-চেতনা ও কর্ম পরিধি সম্পর্কে সহজেই একটি ধারণা অর্জন করা যায়। যে দেশের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা ভীতি ও প্রলোভনে নিয়ন্ত্রিত,সে দেশে সুফিয়া কামালের মতো বিবেকি মানুষকে নিঃসঙ্গ পথিকের মতোই চলতে হয়। তিনি ছিলেন সাধারণের মধ্যে অসাধারণ-সমাজের আটপৌঢ়ে গতানুগতিকতার মধ্যে ব্যতিক্রমী। তাঁর কোমল-পেলব-¯েœহময়ী রূপের আড়ালে ছিল বজ্রের বাণ। ‘জননী সাহসিকা’ – এই হলো তাঁর যোগ্য অভিধা। আমরা বাঙালি ,না বাংলাদেশি? এ সম্পর্কে সুফিয়া কামাল বলতেন,এসব যারা করে করুক। ওসব নিয়ে আমি মোটেই ভাবি না। আমরা বাঙালি-বাঙালি,ব্যস॥ ওসব যারা বলে,তার কোনো মানেও নেই,মূল্যও নেই। চারদিকে অবক্ষয়,অধঃপতন,হতাশা,নৈরাশ্য এই অবস্থা থেকে জাতি হিসেবে আমাদের মুক্তির উপায় সম্বন্ধে তিনি বলতেন,একেবারে সবাই যদি একসঙ্গে থাকত-খালি দল,খালি দল,খালি বিভক্তি,খালি বিভক্তি-এতে কিছুই হবে না। সবাই যদি একত্র হয় তাহলে হবে। উত্তর প্রজন্মের কাছে তাঁর বক্তব্য,প্রত্যাশা এবং বাণী ছিল তারা মানুষ হোক। মনুষ্যত্বের মর্যাদা নিয়ে তাদের নিজেদের মর্যাদায় তারা মানুষ হয়ে জেগে উঠুক। দেশের মানবসমাজের কল্যাণ হোক। সংসার সুশৃঙ্খলভাবে চলুক-এটাই আমি চাই। কী চলছে আজকালকার দিনে? খালি খুনাখুনি মারামারি-বাঙালি হয়ে বাঙালির ওপর অত্যাচার করছে-এই তো দেখছি খালি। অত্যাচারই দেখছি,মানুষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না। নতুন প্রজন্ম,সাহসী হোক তারা,সংগ্রামী হোক। তারা নিজেদের অধিকার বুঝে নিক। কি ছেলে কি মেয়ে সবাই তো নির্যাতিত হচ্ছে! শেষ কথা দুনিয়া ভালো হোক। সারা দুনিয়ায় যে রকম চলছে আজকাল,যে অত্যাচার-অবিচার-সন্ত্রাস,তা থেকে আল্লাহ্ দুনিয়াকে মুক্ত করুক। মানুষ মানুষের মতো যেন বেঁচে থাকে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হল: সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), মন ও জীবন (১৯৫৭), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), অভিযাত্রিক (১৯৬৯), মোর যাদুদের সমাধির পরে (১৯৭২), মায়া কাজল (১৯৯১) ইত্যাদি। গল্পগ্রন্থ: কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭)। শিশুতোষ গ্রন্থ : ইতল বিতল (১৯৬৫), নওল কিশোরের দরবারে (১৯৮২)। আত্মজীবনী: একালে আমাদের কাল (১৯৮৮) ও একাত্তরের ডাইরি (১৯৮৯) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্মৃতিকথা। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), লেলিন পুরস্কার,রাশিয়া (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৭৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), ও স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭) পেয়েছিলেন। সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ শে নভেম্বর ,ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। জন্ম ও মৃত্যুর নিদাঘ নিয়মের মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে তার কীর্তির/অবদানের জন্য। সুফিয়া কামাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর সাহসী ভূমিকা ও নেতৃত্বের জন্য। ২০ শে জুন সুফিয়া কামালের জন্মবার্ষিকীতে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম ও শুভেচ্ছা ।
প্রভাষক সরকার নজরুল ইসলাম, এমসিএসকে।