নির্দিষ্ট সময় খোলেনা বহিঃবিভাগের টিকিট কাউন্টার
এক্সরের টেকনিশিয়ান আসেন ইচ্ছেমতো
রাতে ওষুধ প্রতিনিধিদের আনাগোনা
কামরুল হোসেন মনি, খুলনা : বৃদ্ধা জরিনা বেগম (৭০)। বহিঃবিভাগের মহিলা কাউন্টারে টিকিট নিতে আসেন। বাজে ৯টা ৫ মিনিট। তখনও টিকিট কাউন্টার খোলেনি। বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। দ্রুত ডাক্তার দেখিয়ে আবার বাসাবাড়িতে কাজের তাড়া আছে। ডাক্তার দেখাতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধা ওই মহিলা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখনও গাইনী বিভাগের কোন চিকিৎসককে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি। শুধু গাইনী বিভাগেই না, এ চিত্রটি বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা ডাক্তারদের চেম্বারেও। ডাক্তাররা আসেন দেরিতে, যান নির্দিষ্ট সময়ের আগে। এক্সরে টেকনিশিয়ান আসেন ইচ্ছেমতো। আসেন ১০টার পরে। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটার পর্যন্ত খুলনা জেনারেল হাসপাতালে এই প্রতিবেদক অবস্থানকালে চিকিৎসকদের হাসপাতালে আসা ও তাদের সেবার চিত্র চোখে পড়ে। এ চিত্র যেন নিত্যদিনের।
এমনিতে রোগীর তুলনায় চিকিৎসক কম, তার ওপর সময়মতো ডাক্তার না আসায় রোগীদের অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয়। রোগীদের টিকিট কাউন্টার দেরিতে খুললে সমস্যা নেই, দুপুর সাড়ে ১২টার আগে রোগীদের টিকিট দেন না। চিকিৎসকরাও থাকেন না। হাসপাতালের লোকবল কম থাকার অজুহাতে নার্স ও আয়াদের সঙ্গে কাজ করে দালালরা।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন এ এস এম ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক সার্বিক বিষয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, হাসপাতালে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সকাল ৮টার মধ্যে উপস্থিত হয়ে বেলা আড়াইটার পর অফিস ত্যাগ করবেন। কেউ যদি এর বাইরে অফিস ত্যাগ বা দেরি করেন তাহলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মঙ্গলবার সকাল ৯টা ২২ মিনিট। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কনস্যালট্যান্ট ডাঃ উৎপল কুমার চন্দ। রুম নং-২২। তার রুমের সামনে চিকিৎসাসেবা নিতে দাঁড়িয়ে আছেন রোগীরা। কিন্তু ডাক্তারের খোঁজ নেই। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা জীবনকৃষ্ণ জানান, তিনি রূপসা উপজেলা নন্দনপুর এলাকার বাসিন্দা। কয়েকদিন ধরে জ্বর ও গায়ে ব্যথা না কমায় ডাক্তার দেখাতে আসছি। কিন্তু ডাক্তার না আসায় অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। বহিঃবিভাগে অর্থো-সার্জারি মেডিকেল অফিসার ডাঃ কাজী মঈনুর রহমান। তাকেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার চে¤¦ারে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি। শিশু কনসালটেন্ট ডাঃ মোঃ হাফিজুর রহমান। সোয়া ৯টার অনেক পরে তার চেম্বারে বসেন। এক এক করে রোগী দেখছেন। তখনও কনসালটেন্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ শরাফাত হোসাইন হাসপাতালে উপস্থিত হননি। তিনি ১১টার পর ছাড়া রোগী দেখেন না। আসেনও দেরিতে। সাড়ে ১২টা বাজতে না বাজতে ডাঃ হাফিজুর রহমান চেম্বার ত্যাগ করেন। পাশাপাশি ডাঃ এসএম মুরাদও চেম্বার ত্যাগ করেন। ওই সময় শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ শরাফাত হোসাইন রোগী দেখছেন। কর্তব্যরত নার্সরা এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি ছিলেন তো এখন দেখিনা। স্যাররা তো আমাদের বলে যান না। হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে ১২টা ২৫ মিনিটে পুরুষ বহিঃবিভাগে টিকিট নিতে আসেন নগরীর টুটপাড়া এলাকার বাসিন্দা শামীম হোসেন। ওই সময় টিকিট কাউন্টারে কর্তব্যরত নার্সরা সাফ জানিয়ে দেন, এখন আর টিকিট হবে না। ডাক্তার নেই, আপনি জরুরি বিভাগে চলে যান। ডাক্তার কতক্ষণ পর্যন্ত থাকবেন এমন প্রশ্ন করা হলে, তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। ধমকের সুরে বলেন, এখন কোন টিকিট হবে না।
গাইনী বিভাগে সোয়া ৯টার পরেও কোন চিকিৎসককে চেম্বারে বসতে দেখা যায়নি। সময় যত বাড়ছে, রোগীর সিরিয়ালও তত দীর্ঘ হচ্ছে। গাইনী সার্জারি ডাঃ ফাল্গুনি সিকদার। সময় মতো চেম্বারে আসেননি। সাড়ে ১০টার পর রোগীদের জানিয়ে দেওয়া হয়, ম্যাডামের আসতে দেরি হবে। প্যাথলজি বিভাগের এক্সরে টেকনিশিয়ান মোঃ শহিদুল ইসলামও অফিসে ঢোকেন সাড়ে ১০টার পরে। নগরীর খুমেক হাসপাতালের পূর্ব পাশে বিশ্বাস এনভেসটিকেশন অ্যান্ড ক্লিনিক নামে তার নিজস্ব একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সরকারি হাসপাতালে সময়মতো উপস্থিত না হয়ে ওখানেই বেশির ভাগ সময় দেন। আবার নির্দিষ্ট সময়ের আগে সরকারি হাসপাতালের অফিস ত্যাগ করেন। জেনারেল হাসপাতালে দিনের বেলার পাশাপাশি রাতের বেলায়ও ওষুধ প্রতিনিধিদের আনাগোনা চোখে পড়ে। সন্ধ্যার পর থেকেই একে একে আসতে শুরু করেন। কেউ বা তাদের ওষুধের স্যাম্পল দিতে ব্যস্ত কেউ বা খোশগল্পে মজে যান।
হাসপাতালের অফিস সূত্রে জানা যায়, সরকারি নিয়মানুযায়ী সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবস্থান করবেন। এসে বায়োমেটির ফিঙ্গার প্রিন্টের তার উপস্থিতি নিশ্চিত করে সময়টা। খাতা-কলমে সকাল ৮টার মধ্যে উপস্থিত ও বেলা আড়াইটা পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে দিন-রাতে চিকিৎসা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ওই মেশিনে সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে ফিঙ্গার প্রিন্ট উপস্থিতি দেখানো হচ্ছে। ওই সময়ের মধ্যে ছাড়া ফিঙ্গার প্রিন্ট দিলে অনুপস্থিত শো করবে।
সূত্র মতে, যন্ত্রপাতি ওষুধপথ্যের সরবরাহ যাচ্ছে নিয়মিত, আছে চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী; শুধু নেই কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসকের বদলে নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়ারা রোগী দেখেন, রোগীদের জন্য বরাদ্দ থাকা ট্রলি নিয়ন্ত্রণে রেখে ওই হাসপাতালে বাড়তি টাকা কামায় বহিরাগতরা। দরজা আটকে বিশ্রামে থাকা নার্সদের ডাকলে রীতিমতো রক্তচক্ষু দেখতে হয়। অন্যদিকে কানে মোবাইল ফোন লাগিয়ে খোশগল্প করার ফাঁকে ফাঁকে রোগী দেখা ডাক্তারদের দুর্ব্যবহারের শেষ নেই।
 
					 
                             
                             
                             
                             
                            