সাতক্ষীরায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীর গোপন নিয়োগ বোর্ড বাতিল!

প্রকাশঃ ২০২২-০১-১৫ - ১৩:৪৬

ইউনিক প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা :
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খেজুরডাঙা আর কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের বোর্ড বাতিল করা হয়েছে। সদর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমানের তদারকিতে শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল ১০টায় দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০ লাখ টাকা লেনদেনের বিনিময়ে এ পাতানো নিয়োগ বোর্ড হচ্ছিল। খবর পেয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এ নিয়োগ বোর্ড বাতিল করে দিয়েছেন।
শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেশ কিছু অচেনা লোকের আনা-গোনা দেখে স্থানীয়রা বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে ওই বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণীকক্ষে দুই নারীসহ ১১জনকে বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের কাছে পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রবেশপত্র ছিল। তবে তারা কোন বিষয়ে পরীক্ষা দেবেন তা নিয়ে তাৎক্ষণিক কেউ মুখ খোলেননি।
সেখানকার দায়িত্বপালনকারী জনৈক হাবিবুর রহমান নিজেকে খেজুরডাঙা আর কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উল্লেখ করে বলেন, এখানে একটা মিটিং হচ্ছে। কিসের মিটিং হচ্ছে জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান তার বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইদ্রিস আলীর কাছে ফোন ধরিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। ইদ্রিস আলী বলেন, সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে একজনের স্থায়ীকরণ, একজন প্রহরী ও একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর নিয়োগ পরীক্ষা সেখানে অনুষ্ঠিত হবে।
একপর্যায়ে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে গেলে রাগতস্বরে প্রধান শিক্ষক বলেন, তিনি আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মোস্তাকিমের চাচাত ভাই। তার বোন ফারজানা আক্তার কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাই সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান নিয়োগ বোর্ডের সবাইকে ম্যানেজ করেই আগে থেকে প্রহরী পদে ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে তাহমিদ ও জাহিদকে নিশ্চয়তা দিয়েই বিশেষ প্রক্রিয়ায় কোরাম পূর্ণ করে এ পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। নিয়োগের ব্যাপারে স্থানীয় কাফেলা ও একটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তিনি সেখানে পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন।
আগে থেকে ঠিক করে রাখা সহকারী প্রধান শিক্ষক গোপীনাথপুরের দেবেন গাইন বলেন, তিনি ১৯৯৫ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত। তার বেসিক বেতন ২২ হাজার টাকা। বর্তমানে তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করলেও অনুমোদিত না হওয়ায় সহকারী প্রধান শিক্ষকের বেতন অনুযায়ী বেসিক ২৩ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন না। তাই সবার সহযোগিতায় তিনি ওই পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুমোদন পাওয়ার জন্য এ পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। তবে কোরাম পূরণের জন্য প্রধান শিক্ষকের বোন কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারজানা আক্তার ও বাঁশদহা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তৃপ্তি রানীকে আনা হয়েছে।
খেজুরডাঙা গ্রামের কণ্ঠরাম সরকারের ছেলে প্রবেশ সরকার বলেন, তাকে প্রহরী পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য দাবিকৃত আট লাখ টাকার পরিবর্তে ছয় লাখ টাকা নিলেও চাকরির বয়স নেই দেখিয়ে তাকে পরীক্ষার কার্ড দেওয়া হয়নি।
খেজুরডাঙা গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান সাজু বলেন, পাঁচ মাস আগে পাতানো নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে একজন প্রহরী নেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন। মামলার কারণে ওই সময় পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। এখন প্রধান শিক্ষক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে সমঝোতা করে তিনজনের কাছ থেকে কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা নিয়ে পাতানো নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে তিনি জেনেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, এধরনের পাতানো নিয়োগ বোর্ডের আয়োজনে বেশ দক্ষ সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান। শুক্রবারের এ নিয়োগে তিনি ৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
সাতক্ষীরা সদরের খেজুরডাঙা আর কে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি লাবসা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম সাংবাদিকদের বলেন, পরীক্ষা হওয়ার কথা তিনি জানেন। তবে কোথায় হচ্ছে এটা তাকে অবহিত করা হয়নি। এতে অর্থনৈতিক লেনদেন এর অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নবনির্বাচিত সভাপতি জুনায়েত হোসেন বায়রন বলেন, তাদের বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে এমনটি তাকে কেউ অবহিত করেনি।
সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষাক কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান বলেন, নিয়ম মেনেই নিয়োগ বোর্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। কেন গোপনে বোর্ড বসানো হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রথমে তিনি বলেন, সভাপতি আসতে দেরি করাতে বোর্ড বাতিল হয়েছে। সভাপতি বোর্ড বসানোর স্থান সম্পর্কে জানেন না, এমন কথা জানানো হলে তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তবে ৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বিষয়টি তাকে অবহিত করা হয়নি। তবে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক পাতানো নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।