গোলাম মোস্তফা খান, দাকোপ(খুলনা) থেকেঃ হেমন্ত শেষ হতেই বাংলাদেশের ঋতুচক্রের প্রধান একটি ঋতু শীতের আগমন ঘটে।হাওয়া তখন উত্তর দিক থেকে বৈতে শুরু করে। উত্তরের কনকনে হাওয়ায় ক্রমশ কুয়াশার ধোঁয়াটে চাদুয়াটা ঘন হতে থাকে। কুয়াশার রাতে দশ গজ দুরেও দৃষ্টি যায় না। হাড় কাঁপানি শীত ক্রমশ জেকে বসতে শুরু করে। অগ্রহায়ন ও পৌষ মাসকে শীতকাল বলা হলেও মাঘ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে শীতকাল বিরাজ করে বরং মাঘের শীত কখনও কখনও বেশী বেশী তীব্র হয়ে জানান দেয়। তাইত ভারতের বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকা তাঁর একটি জনপ্রিয় গানে গেয়েছেন,“ মাঘের শীতে বাঘ পালায় বিহার কথা নয়”।যাইহোক মূল বিষয় হল অতিথি পাখি। সেখানেই ফিরে আসা ভাল।আমরা জানি প্রতিবছর শীতকাল এলেই কিছু কিছু নতুন পাখি আমাদের খালে বিলে এবং নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখাযায়। এরা বরফজমা হিমালয় এবং হিমালয়ের ওপাশ থেকে অত্যন্ত শীত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের দেশে চলে আসে। এরা হল অতিথি পাখি।পাখি বিজ্ঞানীদের মতে উপ-মহাদেশে প্রায় ২ হাজার ১০০টি প্রজাতির পাখি আছে। এরমধ্যে প্রায় ৩শ প্রজাতির পাখি হিমালয় পেরিয়ে হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে আমাদের দেশে চলে আসে।এসব পাখিরা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত তিব্বতের লাদাক থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে।শুধু ইউরোপ এবং এশিয়ায় ৬শ প্রজাতির অতিথি পাখি রয়েছে,যারা প্রচন্ড শীতে চলে আসে।
ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশেয়ার,সাইবেরিয়া,এন্টার্কটিকার তীব্র শীত থেকে বাঁচার জন্য অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চল আমাদের দেশে চলে আসে। শীতের পাখিদের মধ্যে বালিহাঁস,গিরিয়া হাঁস,সাদা মানিকজোড়,রাঙ্গামুরি,বড়গুলিন্দা,হট্টি টি,ডাহুক, কোড়া,বাটাং,পানকৌড়ি ,বড় বক অতি পরিচিত নাম।
শীত এলেই অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি বাঁচার জন্য আমাদের দেশে চলে আসে। কিন্তু প্রতিবছর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে যে পাখি আমাদের দেশে বাঁচতে আসে সে পাখিদের নিরাপত্তা সরকারীভাবে দেবার বিধান থাকলেও কার্যত তা হয় না। তাই আইন শুধু কাগজে কলমে থেকে যায়,এদের রক্ষা করার জন্য জনসচেনতামূলক কোনো কার্যক্রম নজরে পড়ে না। নজরে পড়ে না এদের রক্ষা করার জন্য বাস্তব কোন পদক্ষেপ।তাই ক্রমান্বয়ে অতিথি পাখিদের আগমন আমাদের দেশে কমে যাচ্ছে।
শরৎ ও হেমন্তে ইলিশ ধরার জন্য আমাদের দেশে জেলে পাড়ায় যেমন সাজ সাজ রব পড়ে যায় তেমনি শীতের সময় এলে চোরা-গুপ্তা পাখি শিকারীদের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। শিকারীরা হাজার টাকার ফাঁদ,জাল তৈরী করে প্রস্তুত থাকে শীতের পূবেই। বিভিন্ন উপায়ে তারা শিকার করে অতিথি পাখি।গ্রামে ধান ক্ষেতের পাশে ছোট খাল বা চড়ায় ছোট ডিঙি নৌকায় হ্যাচাক জাতিয় আলো জালিয়ে আলোর ফাঁদে কোচ দিয়ে পাখি শিকার করতে দেখা যায়। কেউ কেউ মাছের ঘেরে ফাঁকা যায়গায় দেশী হাঁস পানির উপর জড়ো করে রাখে, পাখি হাঁসের ডাক শুনে পানিতে নামতে শুরু করে তখন পেতে রাখা ফাঁদে আটকে যায়। অনেকে এখন বিভিন্ন হাইড্রোলিক হর্ন পাখি ধরার কাজে ব্যবহার করছে। মুক্ত ফাঁকা জলাশয়ে ফাঁদ পেতে তারা হর্ন বা বাঁশি বাজালে পাখি জলাশয়ে নামতে শুরু করে এবং ফাঁদে আটকে যায়। এ ছাড়াও বড় বড় বাঁশ বাগান,গোলবাগানে রাতে পাখি বসে থাকলে এয়ার গান অথবা সুচালো শিক দিয়ে পাখি শিকার করা হয়। এমনিভাবে প্রতি বছর হাজার হাজার অতিথি পাখি আর ফিরতে পারে না তাদের নিজস্ব বাসভূমে। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে এসে তারা রসনা তৃপ্তির জন্য উঠে যায় বাঙ্গালীর ভাতের থালায়। এরচেয়ে মর্মান্তিক আর কি হতে পারে। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসতে অনেক পাখি অসুস্থ হয়ে এমনিই মারা যায়। তার উপর রয়েছে শিকারির লোলুপ দৃষ্টি। সম্প্রতি বিভিন্ন জায়গায় খবর নিয়ে জানাযায় অতিথি পাখি অনেক চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এর মাংসের চাহিদাও দিন দিন নাকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।এই বিপদজনক চাহিদা থেকে খাদকদের এবং পাখি নিধনকারীদের দূরে না রাখতে পারলে ডুডো পাখির মত অনেক পাখি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।বাড়বে প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতা।
পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু বা প্রাণী নেই যার কোনো গুরুত্ব নেই, তেমনি পাখিও প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ন একটি প্রাণী।পাখি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না এরা অন্যান্য প্রানীর উপকারেও আসে। প্রাকৃতিক বনায়ন সৃষ্টিতে পাখি পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে কাজ নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। প্রকৃতি বান্ধব এসব পাখি শুধু নিজেরা বাঁচতে আসে না। এরা জলজ পোকা,ইন্দুর,কখনো কখনো ধানের পোকা খেয়ে কৃষকের উপকার করে থাকে। পাখি প্রকৃতির ঘন্টা, মানুষের পরম বন্ধু। পাখির ডাকে ভোর হয় আবার পাখির কলকাকলিতে পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নেমে আসে। কোনো কোনো পাখি প্রহরে প্রহরে ডেকে আমাদের প্রকৃতির ঘড়ির কাজ করে থাকে।তাই আসুন সকলে মিলে পাখি নিধন রোধ করি। অতিথি পাখিদের বিচরণের জন্য আমাদের দেশে অভয়ারন্যের সৃষ্টি করি।