এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণ: আবেদন গড়াল উচ্চ আদালতে

প্রকাশঃ ২০২১-০১-২৭ - ২২:০৫

দেশ প্রতিবেদক, সিলেট: সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় দুটি মামলার বিচারকার্য একই আদালতে একসঙ্গে চালানোর আবেদন করেছেন বাদী। উচ্চ আদালতে আবেদনটির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বাদী ও মামলার সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে যাবেন না বলে জানিয়েছেন। ফলে আজ বুধবার সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ থাকার পরও ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে যাননি মামলার বাদীসহ পাঁচ সাক্ষী।

ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহিতুল হক ইনাম চৌধুরী আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের নতুন তারিখ ধার্য করেছেন। এর আগে বেলা ১১টায় আদালতে মামলার আট আসামিকে হাজির করা হলেও বাদীসহ পাঁচ সাক্ষী অনুপস্থিত ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) রাশেদা সাঈদা খানম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আদালত নতুন সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করে ওই তারিখে সাক্ষীদের সমন দিয়ে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নির্দেশনা অনুযায়ী সাক্ষীদের বরাবর সমন পাঠানো হবে।

আজ বুধবার সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ থাকার পরও ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে যাননি মামলার বাদীসহ পাঁচ সাক্ষী।
এদিকে দুটি মামলা একই আদালতে একসঙ্গে বিচারকার্যের আবেদন নিয়ে উচ্চ আদালতে দ্বারস্থ হওয়ার বিষয়ে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একটি দরখাস্ত দিয়েছেন বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। ওই দরখাস্তে হাইকোর্টের আইনজীবীর সার্টিফিকেট দাখিল করা হয়েছে। দরখাস্তে বলা হয়েছে, একই আদালতে দুটি মামলার বিচারকার্যে বাদীর আবেদন খারিজ হওয়ায় উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন বাদী। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের দিকে অগ্রসর না হওয়ার আরজি জানানো হয়।
আদালত সূত্র জানায়, চাঞ্চল্যকর এ মামলায় মোট ৫১ জনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। মামলার বাদীসহ পাঁচজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর তারিখ ছিল আজ। বেলা ১১টায় ট্রাইব্যুনালে মামলার আট আসামিকে হাজির করা হলেও বাদীসহ সাক্ষীরা অনুপস্থিত থাকেন। বাদীপক্ষের আইনজীবীরা সাক্ষীদের বিড়ম্বনার কথা বিবেচনায় নিয়ে ও দ্রুত বিচারের স্বার্থে একই আদালতে একসঙ্গে বিচারকার্যের আবেদন উচ্চ আদালতে করার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের বিচারককে অবহিত করেন।

বাদীপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান শহীদুজ্জামান চৌধুরী মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পেতে আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রাবাসে তরুণীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের আগে তাঁর স্বামীকে (মামলার বাদী) মারধর ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে আরও একটি মামলা হয়। ধর্ষণ মামলার আট আসামিই এ মামলার আসামি। এতে ধর্ষণ মামলার ৫১ সাক্ষীকেও সাক্ষী রাখা হয়েছে। একই ঘটনার পৃথক দুটি মামলা দুটি আদালতে চললে বিচারকার্য বিলম্বিত হতে পারে। এ ছাড়া সাক্ষীদের দুই আদালতে সাক্ষ্য দিতে হবে এবং ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা।’ তাই তাঁরা দুই মামলা একই আদালতে রেখে বিচারকার্য একসঙ্গে চালানোর আবেদন করেছেন।

জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আরও বলেন, ২৪ জানুয়ারি আদালতে এ দুটি মামলার বিচারকাজ একসঙ্গে শুরু করার আবেদন করা হয়েছিল। শুনানি শেষে বিচারক আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর এই আবেদন নিয়ে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন তাঁরা। উচ্চ আদালতে বিষয়টি সুরাহা না হলে বাদী সাক্ষ্য দেননি।

এক ঘটনায় দুবার করে দুটি আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেওয়া শুধু বিড়ম্বনার নয়, নিরাপত্তাসহ নানা রকম জটিলতা রয়েছে। দুই আদালতে এক সাক্ষীর সাক্ষ্য পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এক আদালতে একসঙ্গে বিচারকার্যে বাদীর আবেদন মঞ্জুর হলে শুধু আমি নই, সব সাক্ষী স্বস্তি পাবেন।

এক প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী দেশ প্রতিবেদককে বলেন, এক ঘটনায় দুবার করে দুটি আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেওয়া শুধু বিড়ম্বনার নয়, নিরাপত্তাসহ নানা রকম জটিলতা রয়েছে। দুই আদালতে এক সাক্ষীর সাক্ষ্য পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। একই ঘটনায় একটি আদালতে গিয়ে একবারই সাক্ষ্য দেওয়ার পক্ষপাতি বলে জানিয়ে ওই সাক্ষী আরও বলেন, ‘এক আদালতে একসঙ্গে বিচারকার্যে বাদীর আবেদন মঞ্জুর হলে শুধু আমি নই, সব সাক্ষী স্বস্তি পাবেন।’

এ ছাড়া বাদীর আবেদনে সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া ও আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নিয়োগসহ কিছু অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী। আবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত ৭ ও ৮ নম্বর আসামি আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাহ-উল ইসলামের পক্ষে কোনো আইনজীবী নিযুক্ত করা হয়নি। তাঁদের পক্ষে আইনজীবী না পেলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আইনজীবী নিযুক্ত করে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর কথা। কিন্তু এই ফাঁক রেখে বিচারকার্য সম্পন্ন হলে এই আসামিরা পরবর্তী সময়ে অনুকম্পা পাওয়ার সুযোগ পাবেন। এই প্রসঙ্গ আবেদনে উদ্ধৃত করা হয়েছে এভাবে, ‘৭ ও ৮ নম্বর আসামি কোনো ওকালতনামা দেননি। স্টেট ডিফেন্স না করে জবরদস্তি মূলে মামলার বিচার করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে।’

এ ছাড়া সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আবেদনে বলা হয়, আদালতে সাক্ষ্য দিতে এজাহারকারীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশটি এমনভাবে লেখা হয়েছে, যেন এজাহারকারী নিজে কোনো আসামি। বিধান হলো প্রথমে সমন প্রেরণ। তারপর সাক্ষীর পরোয়ানা, তারপর জামিন অযোগ্য পরোয়ানা। এতে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি।

গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে এক তরুণীকে (২০) দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী বাদী হয়ে মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং দুজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেন। ঘটনার পর আসামিরা ছাত্রাবাস থেকে পালিয়ে গেলেও তিন দিনের মধ্যে ছয় আসামি ও সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও র‍্যাব। গ্রেপ্তারের পর আট আসামিকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। পরবর্তী সময়ে সবাই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার দায় স্বীকার করেন। আসামিদের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষায় আট আসামির মধ্যে ছয়জনের ডিএনএর মিল পাওয়া যায়।

গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, তারেকুল ইসলাম ওরফে তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম ওরফে রাজনকে দল বেঁধে ধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। আসামি রবিউল ও মাহফুজুরকে ধর্ষণে সহায়তা করতে অভিযুক্ত করা হয়। আট আসামিই বর্তমানে কারাগারে আছেন। তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিতি।