চট্টগ্রাম ব্যুরো: গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিভাগীয় বিভিন্ন শহরে টেন্ডারপ্রক্রিয়ায় প্রাক্কলন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। এসব দুর্নীতির সঙ্গে ঠিকাদার আর কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদকের) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, বান্দরবান গণপূর্ত বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের যোগসাজশে দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার মেসার্স এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা সিন্ডিকেট করে উন্নয়ন কাজের কার্যাদেশ হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। তার এ অনিয়মের কারণে জিম্মি হয়ে পড়েছেন পাহাড় অঞ্চলের সাধারণ ঠিকাদাররা।
বান্দরবান গণপূর্ত বিভাগের টেন্ডার প্রক্রিয়া ও উন্নয়ন কাজে বিভিন্ন স্তরে সীমাহিন দুর্নীতির খবর পাওয়া গেছে। দেখা যায়, দর-কষাকষি করে এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন কাজ ভাগিয়ে নেয়। এবং কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে বারবার নির্মাণকাজের নকশা পরিবর্তন করে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করেন।
টেন্ডারের শর্তানুসারে কাজ বুঝে না দিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেরামত বা সংস্কারকাজের নামে ভুয়া বিল–ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ করেন এই এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ইউটিমং।
ইতিমধ্য ঠিকাদার ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর অনৈতিক সুবিধা গ্রহণকে দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার সিন্ডিকেট টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে অনিয়ম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন সরকারের কোটি কোটি টাকা।
কর্মকর্তাদের জাল-জালিয়াতি
দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে ঠুনকো কারণে অপছন্দের ঠিকাদারকে অযোগ্য (নন–রেসপনসিভ) করা হয় এবং কৌশলে পছন্দের ঠিকাদারকে যোগ্য (রেসপনসিভ) করা হয়। এখন ই-জিপির মাধ্যমে টেন্ডার আহ্বান করা হলেও টেন্ডার দাখিলের আগেই গোপন সমঝোতার মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদারকে মূল্য জানিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পছন্দের ঠিকাদারের যেসব অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেসব অভিজ্ঞতার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, যাতে অন্য ঠিকাদার টেন্ডারে অংশ নিতে না পারেন।
আবার ঠিকাদারদের যোগসাজশে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে নির্ধারিত দামের বাইরে গিয়েও অনেক ক্ষেত্রে প্রাক্কলন তৈরি করার তথ্য পাওয়া গেছে বান্দরবান গণপূর্ত বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, গতঅর্থবছরে বান্দরবান গণপূর্ত বিভাগ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের টেন্ডার আহ্বান করে। তার মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি ছোট কাজ এলটিএম করে উন্মুক্ত লটারি পদ্ধতিতে সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অংশ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। বাকি অধিকাংশ উন্নয়ন কাজই ওটিএম এবং ওএসটিএম কোটেশন পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করে কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যোগসাজশের মাধ্যমে সিন্ডিকেটভুক্ত পছন্দের ঠিকাদারদের উন্নয়ন কাজের নির্ধারিত দরদাম (রেইট কোড) তথ্যটি নিয়মনীতি বর্হিভূতভাবে ফাঁস করে জানিয়ে দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।
নির্মাণকাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ
বান্দরবানসহ বিভিন্ন জায়গায় উন্নয়ন মূলক নির্মাণকাজে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়েও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মের্সাস এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা। ইট, রড, সিমেন্ট ও বালু ব্যবহারেও অনিয়মের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। অনেক ক্ষেত্রে যে অনুপাতে সিমেন্ট ও বালু মেশানোর কথা, তা না করে বালুর পরিমাণ বেশি মেশানো হয়েছে।
যে নমুনা অনুযায়ী রড দেওয়ার কথা, তা না করে তা থেকে কম পরিমাপের রড এবং যে ঘনত্বে রড দেওয়ার কথা, তা না করে রডের পরিমাণ কম দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজশে এমটা করেছেন বলে জানা যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউটিমং এর বিরুদ্ধে।
আর এদিকে সিন্ডিকেটভুক্ত মুষ্টিমেয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কোটেশনকৃত নির্ধারিত দামেই দরপত্র জমা করে কাজ ভাগিয়ে নেন অনন্ত বিকাশ। ফলে সাধারণ ঠিকাদাররা দরপত্র সংগ্রহ করলেও ভাগ্যে জুটে না কোনো উন্নয়ন কাজ। অপরদিকে নির্ধারিত দরদামে কাজ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কাছ থেকে উন্নয়ন কাজের বিপরীতে ৫% থেকে ১০% পর্যন্ত অর্থ হাতিয়ে নেয় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীসহ কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, বান্দরবান সিন্ডিকেটের প্রধান মুলহোতা হচ্ছে ঠিকাদার ইউটিমং এস.অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা, এবং মেসার্স রয়েল অ্যাসোসিয়েটসের রোটারিয়ান মো. ফারুক চৌধুরী। এবং মেসার্স মেরিনা কনস্ট্রাকশন।
জানা যায়, গত ৫ বছরে ২৩৭ টি কাজ ভাগিয়ে নিয়েছেন এই এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা। তার কাজের বাৎসরিক গড় ১৪৩.৪০ কোটি টাকা। এবং বর্তমান চলমান কাজের মূল্য ৭৪.৬০ কোটি টাকা। সর্বমোট ৭১৭ কোটি টাকা। বান্দরবান গণপূর্ত বিভাগের উন্নয়ন কাজের মধ্যে লাভজনক কাজেই বাস্তবায়ন করছেন প্রভাবশালী এই ঠিকাদার অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা। বাকি কাজগুলোর মধ্যেও বেশ কয়েকটি কাজ তার পছন্দের ব্যক্তিরা পেয়েছেন।
অনন্ত বিকাশ সিন্ডিকেটের বাহিরে অন্যকোনো ঠিকাদার দরপত্র সংগ্রহ (কিনে) নির্ধারিত দামের চেয়ে কমদামে দরপত্র জমা দিতে চাইলে সিন্ডিকেট চক্রের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। ভয়ভীতি দেখানো হয় কাজটি বাস্তবায়ন করে কিভাবে লাভ করবে দেখে নেয়ার। এমন কি কাজ পেতে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদেরও ভয় ভীতি দেখান এই অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা।
এ বিষয়ে জানার জন্য অভিযুক্ত ঠিকাদার মেসার্স এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার মোবাইল ফোনে একাদিকবার কল দেয়া হলেও মোবাইলফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে গণপূর্ত মন্ত্রানালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার নামে অনেক অভিযোগ আমরা পেয়েছি, তার দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত চলছে, সে যদি অভিযুক্ত হয় তাহলে তার লাইসেন্স বাতিল হবে এবং তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চত করা হবে।