ধর্মপাতা : সবুজে আবৃত চল্লিশ ফুট উঁচু এক টিলা। এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক বিবিচিনি শাহি মসজিদ। বরগুনার এই মসজিদটি বয়স পেরিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন শ বছর। প্রাচীনতার সাক্ষী এই মসজিদটিতে মোগল নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্যরীতির ছাপ দেদীপ্যমান। মসজিদের আশপাশের পরিবেশ-প্রকৃতি হৃদয়ছোঁয়া। দক্ষিণাঞ্চলের ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে অবহিত করা হয় এ মসজিদকে। বরগুনার বেতাগী উপজেলা সদর—সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বিবিচিনি ইউনিয়ন। সেখানেই অবস্থিত এই মসজিদটি। জানা গেছে, মসজিদটি দেখতে বছরজুড়ে পর্যটক ও দর্শনার্থীরা এখানে সমাগম করেন। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ঐতিহাসিক প্রাচীন এই মসজিদটি অনেকদিন ধরে প্রয়োজনীয় সংস্কার পাচ্ছে না। রক্ষণাবেক্ষণেও রয়েছে ব্যাপক অবহেলা। ফলে মসজিদটি প্রাচীন সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। নির্মাণকালের সাত-সতেরো ইতিহাস থেকে জানা যায়, হজরত শাহ নেয়ামত উল্লাহ নামের এক সাধক ছিলেন। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি পারস্য থেকে দিল্লিতে আসেন। সে সময়ে মোগল স¤্রাট শাহজাহানের ছেলে বঙ্গ দেশের সুবাদার শাহ সুজা এই মহান সাধকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তিন-চার বছর কেটে যায় তার দিল্লিতে। কিন্তু শাহ সুজার আগ্রহে ১৬৫৯ সালে কয়েকজন শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বেতাগীর এই গ্রামে আসেন। শাহ সুজার অনুরোধেই এই গ্রামে তিনি এক গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ নির্মাণ করেন।
বিবিচিনি শাহি মসজিদ
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। দেয়ালগুলো ছয় ফুট চওড়া। উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে তিনটি করে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ রয়েছে। তবে মূল প্রবেশদ্বার একটি। ইট-গাঁথুনি ধূসর বর্ণের। ইটের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং চওড়া ২ ইঞ্চি। ইদানিংকালে এ ধরনের আকৃতির ইট নিতান্তই অলীক ও আলাদা। মুসল্লি ও দর্শনার্থীদের ওঠানামার জন্য মসজিদের দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে সিঁড়ি রয়েছে। দক্ষিণ পাশের সিঁড়িটি ৪৮ ফুট (২১ ধাপবিশিষ্ট) দীর্ঘ এবং পূর্ব পাশেরটি ৪৬ ফুট (২৫ ধাপবিশিষ্ট) লম্বা। মসজিদে আসা-যাওয়ার একমাত্র সড়কটি বহুদিন ধরে ব্যবহারের অনুপযোগী। পূর্ব সিঁড়িটির অবস্থাও নাজুক। মসজিদের প্রবেশদ্বারের মূল ফটক সংস্কার করা হলেও প্রবেশপথ এখনো অপরিসর। অনেক সময় মুসল্লি ও পর্যটকদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় এর কারণে। মসজিদটিতে যাওয়া-আসার জন্য যে সিঁড়ি রয়েছে, তাও দেবে গেছে। এতে ওঠানামায় মুসল্লি ও পর্যটকদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। ছবি: সংগৃহীত
বিবিচিনি শাহি মসজিদ
বিবিচিনি মসজিদের পাশে তিনটি কবর রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, কবরগুলো শাহ নেয়ামত উল্লাহ, তার দুই মেয়ে চিনিবিবি ও ইছাবিবির। স¤্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ১৭০০ সালে শাহ নেয়ামত উল্লাহ ইন্তেকাল করেন।
বিবিচিনি শাহি মসজিদ
ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকে রয়েছে এই শৈল্পিক মসজিদ-স্থাপত্য। দীর্ঘদিন অরক্ষিত ও জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকার পর প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর এটি উদ্ধার করে। ১৯৮৫ সালে মসজিদটির দেয়ালের কিছুকিছু অংশের পলেস্তারা খসে যায়। তখন উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে মেরামত করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব নিয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকাভুক্ত করে। মসজিদটি দেখাশোনার জন্য প্রতœতত্ত্ব বিভাগ একজন অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়কও নিয়োগ করে।
পরবর্তীতে কিছুটা সংস্কারকাজ করা হয়। কিন্তু তাতে রয়েছে অযতœ আর অবহেলার ছাপ। মসজিদের পুরনো কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে হুবুহু মিল রেখে এ সংস্কার করা হয়। মসজিদের ভেতরে অবাধে বাতাস চলাচলের পথগুলো উন্মুক্ত রাখা হয়। কোনো রকম করে বৈদ্যুতিক বাতি ও পাখা স্থাপন করা হয়। কিছুটা সংস্কারকাজ হলেও তাতে রয়েছে অযতœ আর অবহেলার ছাপ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সালে মসজিদের আরো সৌন্দর্য বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত সম্প্রসারণ ও সংস্কারের জন্য প্রতœতত্ত্ব বিভাগ এক কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিলেও আজও তা আলোর মুখ দেখেনি।
বিবিচিনি শাহি মসজিদ
দীর্ঘদিন শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে মসজিদের সামনের রাস্তাটি। বিশুদ্ধ পানি, অজু ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। ফলে দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকরা বিভিন্ন সমস্যা ও অসুবিধায় পড়েন। এছাড়াও মসজিদের টিলার চারপাশের মাটি কেটে সে জমিতে চাষাবাদ করছে এলাকার কিছু লোকজন। এতে মসজিদটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। মসজিদটিতে যাওয়া-আসার জন্য যে সিঁড়ি রয়েছে, তাও দেবে গেছে। এতে ওঠানামায় মুসল্লি ও পর্যটকদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। অন্যদিকে পর্যটকরা থাকার জন্য ডাকবাংলো বা এ ধরনের কিছু নেই। তবু পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে প্রায় সময়।
বিবিচিনি শাহি মসজিদ
বরগুনা থেকে বাসযোগে বেতাগি। এরপর মোটরসাইকেল অথবা রিক্সাযোগে গন্তব্যস্থল। বরিশাল থেকে বাস যোগেও সরাসরি এই দর্শনীয় স্থানে যাওয়া যায়।