নিউটন দাশ, চট্টগ্রাম :
রেলওয়ে অতিরিক্ত প্রধান সরঞ্জাম কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে একই অফিসে দশ বছর যাবৎ অবৈধ উপায়ে শতকোটি টাকা আয় করার অভিযোগ করেছেন সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য রোকন উদ্দিন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবরে দায়েরকৃত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ রেলের সরঞ্জাম বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান আনোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন যাবত দুর্নীতির মাধ্যমে নিজস্ব ঠিকাদারদের মাধ্যমে রেলে বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ইতিমধ্যে একাধিক পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর নড়েচড়ে উঠেছে রেলওয়ে প্রশাসন।
জানা যায়, একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হওয়ার পর মোবাইল বন্ধ করে অফিস ছেড়ে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তদবির চালাচ্ছেন রেলের সরঞ্জাম বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন।
বিশেষ করে রেলের বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয়ে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকলের মধ্যে টক অব দ্য রেলে পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এই কর্মকর্তা গত প্রায় ১০ বছর ধরে চট্টগ্রামের একই অফিসে জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক/ক্রয়-১, কখনো জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক/ক্রয়-২, কখনো জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক/পরিদর্শন পদে বছরের পর বছর ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে প্রায় কয়েকশত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
গত ২ বছরে এই কর্মকর্তা অতিরিক্ত প্রধান সরঞ্জাম কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান। কিন্তু উক্ত পদে পদোন্নতি পেলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে বিভাগীয় পর্যায়ের লোভনীয় পদ জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক/পরিদর্শন পদটিও বাগিয়ে নিয়েছেন।
সূত্র জানায়, পূর্বাঞ্চল রেলে প্রতিবছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার কেনাকাটা হয়। এসব কেনাকাটার সব মালামাল জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক/পরিদর্শন দফতরে তার হাত দিয়েই পাস করানো হয় এবং তাকে কমপক্ষে ৫-১০ শতাংশ করে কমিশন হিসেবে দিতে হয়, যেটা অনেকেই বা তিনি নিজে বৈধ হিসেবেই জানেন। বর্তমানে তার ক্ষমতার খুঁটি এতই জোরালো যে, তিনি যে কোনো বড় কর্মকর্তা বা বড় ঠিকাদারকেও তোয়াক্কা করেন না। এর মূল কারণ মন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি নিজের প্রভাব বিস্তার করে চলছেন রেলে।
জানা যায়, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক পদটি ওই অফিসের প্রধান হলেও তিনি এবং তার সিন্ডিকেটের লোকজনের কাছে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক প্রায় অসহায়। ফলে কোনোভাবেই কোনো কর্মকর্তা তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য তাকে সরিয়ে জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক/পরিদর্শন পদে বসার সাহস পর্যন্ত দেখাতে কেউ সাহস পান না।
এই আনোয়ারের সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তারা হলেন- সিটিসি সেকশনের প্রধান সহকারী তারেকুল ইসলাম, সাজিয়া সিরিন, ফয়সাল আহমেদ এবং ক্রয় শাখার নাসরিন সুলতানা, তার নিজের শ্যালক রিদয় ইসলাম (যার মাধ্যমে তিনি ঘুষের টাকা লেনদেনের কাজ সম্পন্ন করেন), ক্রয়/১ শাখার সাহেদ হক (তার সকল খারাপ কাজের সহযোগী), সাজ্জাদ ইসলামও আনিস।
তার সিন্ডিকেটের বাইরে কোনো সরবরাহকারীর কাজ গেলেই আগে তার পেমেন্টের বিষয়টি এসব সহযোগী তার বিশেষ ইঙ্গিতে ক্লিয়ার করে নেন। এরপর তার ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর তার সিন্ডিকেটের লোকজন তার বাসায় গোপনে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং মূহূর্তেই গোপনে সব সই স্বাক্ষর হয়ে যায়। তাছাড়া তার সিন্ডিকেটের ঠিকাদারদের কাজও একইভাবে গোপনে সম্পন্ন হয়ে যায়।
সাধারণত প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের এপিপি বা বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা পাসের ক্ষমতা ৫ লাখ টাকা। এর বেশি হলেই ফাইল পাঠাতে হয় রেলভবনে অতিরিক্ত মহাপরিচালক/আরএসের কাছে। রেলভবনে ফাইল যেতে না যেতেই সব বড় ফাইল বা চাহিদা কাটছাঁট করে ৫ লাখ করে ছোট ছোট করে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে সরাসরি পিপিআর-২০০৮ এর সরাসরি লঙ্ঘন করছে। কারণ পিপিআর-২০০৮ এ স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে কোনো বড় কাজকে কখনোই ছোট করা যাবে না।
কিন্তু নিয়মের তোয়াক্কা না করে এই কর্মকর্তা একটি কাজকে ১০০টি বা ১৫০টিরও বেশি করে ভেঙে ভেঙে ক্রয় করেন, যা ২০১৯ এবং ২০২০-এর ফাইল দেখলেই বোঝা যাবে। এ ভাঙা কাজ সাধারণত তার সিন্ডিকেটের ঠিকাদার ছাড়া আর কেউ পান না। যেমন-হাসান নামের একজন ঠিকাদার গত ২ বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি কাজ সম্পন্ন করেছেন। এই কর্মকর্তা তার দুই ভাতিজাকে ব্যবসায় নামান। এই ভাঙা কাজের মাধ্যমে তাদরকে কোটি কোটি টাকার কাজ দেন।
এদের একজন হলো তূর্য, যার নামে প্রতিষ্ঠানের নাম তূর্য এন্টারপ্রাইজ। তূর্য এন্টার প্রাইজের মাধ্যমে প্রায় তিনি প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করেন। বিষয়টি নিয়ে একটি আলোচনা-সমালোচনা শুরু হতেই তিনি তূর্যকে বাদ দিয়ে আরেক ভাতিজা তনয়কে নিয়ে আসেন। বর্তমানে তনয়-আনোয়ারুল অফিসে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলেন।
তনয় এই কর্মকর্তার বাসাতেই থাকেন। তিনি কোন ঠিকাদারকে কাজ দিতে হবে, কাকে ম্যানেজ করতে মন্ত্রীর লোককে কীভাবে ম্যানেজ করতে হবে- সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের অফিসের সবচেয়ে বড় চুরির জায়গা হলো ইঞ্জিনের মালামাল, যা ডিজেল আইটেম নামে পরিচিত। এ মালামাল সাধারণত কানাডা বা আমেরিকা থেকে আসার কথা বা অনেক সময় ইন্ডিয়া থেকে আসার কথা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো এসব মালামাল সবই কেনা হয় পুরান ঢাকার ধোলাই খাল এলাকা থেকে। এই মাল এখান থেকে কিনে তা পাঠানো হয় কানাডা বা আমেরিকায় যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের ভাড়া বাসা বাড়িতে। পরে এটিই আবার সিল দিয়ে বাংলাদেশে আনা হয়।
ধোলাই খাল এলাকা থেকে ৫০০ টাকায় এই মাল কিনে আমেরিকা থেকে আনা হয় ৫০০ ডলার দিয়ে। এভাবে দেশের মূল্যবান অর্থ পাচার করে এই চক্র দেশের রেলওয়ে খাতকে পঙ্গু করেছেন।
এভাবে অর্থ লুটে এলাকায় তিনি প্রায় ১৫০ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন এবং পুরো জমিই শতাধিক সিসিটিভি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করেন। তার অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়গুলো রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আনলেও মাসোহারার কারণে কেউই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
এ বিষয়ে জানার জন্য আনোয়ারুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ ভিত্তিহীন উল্লেখ করে।