বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিক্ষেত্র বিল ডাকাতিয়া। বিলটি খুলনা জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি নিম্নাঞ্চল, গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা বিধৌত বদ্বীপীয় সমভূমি। এর আশীর্বাদে এ এলাকায় কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি এবং বর্ণাঢ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজ করত। খুলনা ও যশোরের ছয়টি উপজেলার অভ্যন্তরে প্রায় ৩০ হাজার একর জমি নিয়ে গঠিত বিল ডাকাতিয়া মানুষের কাছে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। আর বৃষ্টির সময়ে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ানোর শঙ্কায় রয়েছে এলাকাবাসী।
১৯৮৪ সালের বন্যায় ১২ বছরের জলাবদ্ধতার পর ১৯৯২-৯৩ সালে ২২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা-যশোর নিষ্কাশন পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ ছাড়া শলুয়া স্লুইসগেট থেকে কৈয়া নদী খনন এবং শলুয়া থেকে বিল ডাকাতিয়ার মাঝখান দিয়ে ফুলতলার পিপরাইল গ্রাম পর্যন্ত ৮০ ফুট চওড়া খাল খননের পর বিলের পানি নিষ্কাশন শুরু হয়। এরপর কয়েক বছর মোটামুটি জলাবদ্ধতামুক্ত হয়ে ‘অভিশাপ’ কাটিয়ে বিল ডাকাতিয়া হয়ে ওঠে ‘আশীর্বাদ’। কিন্তু জমির মধ্য দিয়ে ১১টি নদী প্রবাহিত হলেও সম্প্রতি ভরাট হয়ে যাওয়ায় শোলমারী ও ভদ্রা নদী দিয়ে বিলের পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। সে কারণে দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বিল ডাকাতিয়া ও ভবদহের পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে জলাবদ্ধতায় চাষিরা বিপাকে পড়ে। ফলে পেটের অসুখ, আমাশয়, জ্বর, আন্ত্রিক ও চর্মরোগ ছড়িয়ে পড়ে। জলাবদ্ধতা, অধিক লবণাক্ততা ও অবক্ষেপণ এই এলাকার উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, পাখ-পাখালি ও গরু ছাগলের মতো গৃহপালিত পশুর অনুকূল পরিবেশও বিঘ্নিত হয়। পানিতে তলিয়ে যায় মাঠ-ঘাট, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাছের ঘের, ধান-সবজির ক্ষেত, তলিয়ে যায় বসতবাড়িগুলো। চারিদিকে পানি জমায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারে না। ঘেরের আইলে থাকে সবজি, আর ঘেরে থাকে মাছ। অতি বর্ষণে সবজিসহ প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমির চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বসুরাবাদ, মুজারঘুটা, কৃষ্ণনগর, বটবেড়াসহ এ অঞ্চলের মৎস্য চাষি ও কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে অনাহারে ও অর্ধাহারে দিন কাটায়। জমি থাকলেও অনাহারে থাকতে হয় কৃষিজীবীদের। অপরদিকে ব্যাংক, এনজিও, বিভিন্ন সমিতি ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয়া কৃষকদের উপর কিস্তির চাপ সৃষ্টি করায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুম চলমান, তাছাড়া এবার বৃষ্টির সম্ভাবনাও বেশি, তাই কৃষি ও মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এলাকার কৃষিজীবী মানুষ। অথচ এই সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে অব্যবস্থাপনাপূর্ণ মৎস্যঘেরশিল্প। ২০১৯ সালে মৎস্যঘের স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি হিসেবে, ভবদহ এলাকায় প্রায় ১৮ হাজার মাছের ঘেরের মধ্যে মাত্র ৩২টি ঘের নিবন্ধিত। অধিকাংশ ঘেরমালিক এই নীতিমালার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। নীতিমালায় বলা আছে, ঘেরের আয়তন সর্বোচ্চ ১৫ হেক্টর হবে (সমবায় ভিত্তিতে ৫০ হেক্টর), কিন্তু বাস্তবে, ঘেরের আয়তন ২০০ হেক্টরেরও বেশি। ঘেরের মাঝখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নেই, বরং একের পর এক বাঁধ দিয়ে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ রুদ্ধ করা হয়েছে। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ঐ এলাকার উজান অঞ্চলে বিভিন্ন নদীর প্রবাহ আকস্মিকভাবে কমে যাওয়া, বাঁধ ও পানি নিয়ন্ত্রক খালসমূহের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং চিংড়ি ঘেরগুলো প্রভাবশালীদের দ্বারা যথেচ্ছভাবে পানি প্রবাহের ভিন্নমুখীকরণ। তাছাড়া ঘেরমালিকেরা নদীর পাড়, সরকারি খাল ও সড়কের পাশে ঘেরের বাঁধ গড়ে তুলেছেন। এভাবে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই পরিস্থিতির জন্য শুধু ঘেরমালিকেরা নন, প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়ও দায়ী।
গত ২২ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ভবদহ স্লুইসগেট ২১ ভেন্ট এলাকা পরিদর্শন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বিভিন্ন সময় সরকারের কর্তাব্যক্তিগণ এলাকার সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেও স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় এ সমস্যা সমাধানে আশায় বুক বেঁধেছে ডাকাতিয়া বিল ও ভবদহ পাড়ের কৃষিজীবী মানুষ। সরকারি হস্তক্ষেপে আফিলগেট এলাকায় ভৈরব নদের সাথে ডাকাতিয়া বিলের সংযোগ খাল খনন, শোলমারি ও ভদ্রা নদীর পলি অপসারণ, শলুয়া স্লুইসগেট থেকে কৈয়া নদী পুনঃখননসহ সকল স্লুইসগেটের পলি অপসারণ এবং সরকারি নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বিলের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান চান এলাকার খেটে খাওয়া মানুষগুলো। দ্রুততম সময়ের মধ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে; এবারের বর্ষা মৌসুমে ডাকাতিয়া বিল এবং ভবদহ এলাকায় তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পরিবেশবাদীগণ।
লেখকঃ
গাজী মোহাম্মদ এনামুল হক
পরিবেশবাদী, শিক্ষক অ্যাম্বাসেডর ও
প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ, খুলনা।
মোবাইলঃ ০১৯১১-৪০২০২৫