কপিলমুনি প্রতিনিধি : প্রতিষ্ঠার পর ৯১ বছর পার করে ৯২-তে পা রেখেছে কপিলমুনি সরকারি হাসপাতালটি, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি নিজেই রুগ্ন। জনবল সংকট আর অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়লেও কেউ খোঁজ নেয়নি চির অবহেলিত এ হাসপাতালটির।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পাইকগাছা, কয়রা ও তালা থানার লাখ লাখ মানুষ সে সময় ছিল সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। তাই বৃহৎ এই কয়’টি থানার অসংখ্য মানুষের সুচিকিৎসার কথা ভেবে কপিলমুনির প্রয়াত দানবীর রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ১৯২৫ সালের ৭এপ্রিল ৩একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন ২০ শয্যা ভরত চন্দ্র হাসপাতাল। হাসপাতালটি তৈরীর সময় অনেকাংশে মার্বেল পাথর স্থাপন করা হয়। ভবনটি দেখতে যেন সুরম্য অট্টালিকা। স্থাপন করা হয় ডিসপেনসারী কক্ষ, কলেরা ওয়ার্ড, কর্মচারী কোয়াটার, ডাক্তারদের আবাসিক ভবন, লাশ রাখার ঘর, শৌচাগার, অপারেশন থিয়েটার, ডেলিভারী কক্ষ সহ লোহার তৈরী ঘোরানো পেচানো সিড়ি, বৃহৎ একটি পুকুর, সীমানা প্রাচীরসহ কোলকাতা থেকে আনা আধুনিক যন্ত্রপাতি। যার অনেক কিছুই এখন নষ্ট হয়ে গেছে, আধুনিক সেই সব যন্ত্রপাতি হাসপাতালটিতে এখন আর চোখে পড়েনা। হাসপাতালের সীমানা প্রাচীরের একটা অংশ ভেঙ্গে গেছে। পার্শ্ববর্তী এলাকার কতিপয় মানুষ হাসপাতাল চত্ত¡রটি যেন গোচারণ ভূমিতে পরিণত করেছে। গরু-ছাগল ভিতরে প্রবেশ নিষেধ; এমন একটি সাইনবোর্ড প্রধান গেটের কাছে দেওয়া থাকলেও তা মানতে নারাজ তারা।
মহা-দানবীর রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ২০শয্যার হাসপাতালটি ১৯৭১ সালে সরকারী করণের সময় প্রতিষ্ঠাতার দেওয়া নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয় কপিলমুনি ১০ শয্যা সরকারি হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কয়েকবার সরকার ও স্থানীয় নের্তৃত্বের পরিবর্তন আসলেও কপিলমুনি হাসপাতালটির উন্নয়ন হয়নি। বিভিন্ন সময় মন্ত্রী-এমপিরা উন্নয়নের প্রতিশ্রæতি দিলেও তা এখনো বাস্তবের অপেক্ষায়।
এবিষয়ে স্থানীয় গুণীজন স্মৃতি সংসদের সভাপতি আঃ সবুর আল-আমীন বলেন, ‘গুনীজনদের স্মৃতি রক্ষার কাজ করি। এলাকার বিশিষ্ট গুণীজন দানবীর বিনোদ বিহারী সাধু মানুষের সু-চিকিৎসার জন্য ২০ শয্যা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু সরকারি করার সময় কমিয়ে ১০ শয্যা করা হয়, যেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের বিষয়’।
সরেজমিনে মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালে গেলে অনুসন্ধানে উঠে আসে জানা-অজানা অনেক তথ্য। জানাযায়, এখানে দীর্ঘদিন কোন ডাক্তার ছিলেন না, ফলে কোন রোগীর চিকিৎসা হয়নি। অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে এসে ফিরে গেছেন বলে জানালেন স্থানীয়রা। প্রতিষ্ঠানটিতে ২ জন ডাক্তারের পদ রয়েছে। কিন্তু মাত্র ২ সপ্তাহ আগে ১ জন যোগদান করেছেন। সদ্য যোগদানকারী মেডিকেল অফিসার মোঃ আব্দুর রব এখন প্রায় ২ লক্ষ মানুষের চিকিৎসায় নিয়োজিত। যিনি রাত দিন অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। যা একজন ডাক্তারের পক্ষে সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, কপিলমুনি হাসপাতালটি সরকারি হওয়ার পর থেকে সৃষ্ট পদে ২ জন ডাক্তারকে সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিয়োগ দেয়। দীর্ঘদিন চলতে থাকে এভাবে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এখানে ১ জন ডাক্তার দিয়ে অসংখ্য রোগীর সেবা দেওয়া হচ্ছে। তাও আবার কোন কোন সময় মাসের পর মাস নার্সের ঘাড়ে ভর দিয়ে ডাক্তার শুণ্য অবস্থায় চলে হাসপাতালটি। অনেক আগে থেকেই প্রতিদিন ৩ শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে এসে থাকে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ডাক্তার শুন্য থাকায় সেবা বঞ্চিতরা অনেকই এখন আর এখানে আসেন না।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, এখানে বর্তমানে এখানে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ১জন, এছাড়া রয়েছন নার্স ২ জন, ফার্মাসিস্ট ১জন, এম এল এস এস ২ জন, সুইপার ২ জন, বাবুর্চী নাইটগার্ড ও ওয়ার্ডবয় নেই। জরুরী রোগী স্থানন্তর করার জন্য এ্যাম্বুলেন্স নেই।
কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার মোঃ আব্দুর রব এ প্রতিবেদককে জানান, এখানে ডাক্তারসহ পর্যাপ্ত জনবল নেই। প্রতিদিন শতশত রোগী দেখতে হয়, বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তিনি আরো জানান, সুচিকিৎসার জন্য এখানকার জনবল বাড়াতে হবে, রোগীর জন্য এ্যাম্বুলেঞ্জ ইমার্জেন্সী রুম ও ডাক্তারদের কোয়াটার নেই। রোগী আছে কিন্তু বিভিন্ন সরমঞ্জাম না থাকার কারণে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়’।
হাসপাতালটিতে সেবা নিতে আসা রবিউল শেখ (৪৮) বলেন, এখানে সব কিছুর অভাব, উন্নত চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ডাক্তার ও যন্ত্রপাতি নেই। ফলে জরুরী রোগীগুলো খুলনা, যশোর, ঢাকা আবার কখনো বিদেশে নিতে হচ্ছে।
পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ প্রভাত কুমার দাশ বলেন, কপিলমুনি হাসপাতালে ২ জন ডাক্তারের পোষ্ট রয়েছে, কিন্তু বর্তমানে সেখানে ১ জনকে দেওয়া হয়েছে। সরাদেশে ডাক্তার সংকট। পাইকগাছা হাসাপাতালটিতেও পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই, ফলে এখানেও আমাদের রোগীর সেবা দিতে ভীষণ কষ্ঠ হচ্ছে। তবে আমি আশাবাদী সরকার আগামীতে ডাক্তার নিয়োগ দিলে তখন ওখানে ডাক্তার সংকট থাকবে না’।
এই হলো কপিলমুনি হাসপাতালের সার্বিক চিত্র। স্থানীয়রা বলছেন, ৯২ বছর ধরে চিকিৎসা সেবা দিতে দিতে হাসপাতালটি এখন হয়তোবা নিজেই রোগী হয়ে গেছে, যেটা ভিতরে প্রবেশ না করলে বোঝা যাবে না। বাইরে থেকে দেখতে তাল পুকুর মনে হয়, কিন্তু আসলেই ঘটি ডোবে না। ভূক্তভোগীরা বলছেন, এমন কি কেউ আছেন যিনি এ রুগ্ন প্রতিষ্ঠানটির একটু খানি উন্নয়নে এগিয়ে আসতে পারেন?
জীর্ণ কোয়াটারে পানি ও সাপপোকারসাথে স্টাফদের বসবাস
হাসপাতালটির কোয়াটারের যে কয়টি ঘর রয়েছে তা দুর থেকে দেখলে অতি সহজেই যেন মনে হয় এটা কোন বস্তির অংশ। আসলে কিন্তু না, এটি হাসপাতালটির কোয়াটার যেখানে ডাক্তারসহ সংশ্লিষ্ট স্টাফদের আবাসিক স্থান। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু এগুলো তৈরী করার পর আর কোন রকম সংস্কার বা কাজ করা হয়নি। সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতাল চত্ত¡রের পানি জমে আছে, অধিকাংশ স্থান এখনো বর্ষার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। বর্ষা মৌসুম এলেই স্টাফ কোয়াটারের ভেতরে চলে পানির খেলা। ৪ জন স্টাফকে বসবাস করতে হয় সাপপোকার সাথে। এসময়টা তাদের নিদারুন কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়। এছাড়া কোয়াটারের দেয়াল, ছাদ, জালালা, দরজা ভেঙ্গেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তারের কোয়াটারটি একেবারেই বসবাসের অনুপোযোগী হওয়ায় কর্তব্যরত ডাক্তারকে বাধ্য ১ কিঃমিঃ দূরে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। ফলে রাতের বেলায় সেখান থেকে এসে জুরুরী রোগী দেখা অনেকটা কষ্ঠসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনতিবিলম্বে কোয়াটারের কক্ষগুলো সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা জরুরী হয়ে পড়েছে বলে দাবী এলাকাবাসীর।