কামরুল হোসেন মনি, খুলনা : অবুঝ শিশু রোদেলার বয়স এক বছর ৮ মাস। তাকে রেখে পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে তার মা মরিয়ম আক্তার সোনিয়া (২৮)। কিন্তু মৃত্যুর অর্থ জানে না রোদেলা। মানুষ মরে গেলে আর কখনো ফিরে আসে না, একথা বোঝার বয়স হয়নি তার। মায়ের মৃত্যুর পর মাকে সে কেঁদে কেঁদে খুঁজেই চলেছে। মায়ের বুকের দুধ পান করার তৃষ্ণা পেয়েছে। তাকে বোঝানো হচ্ছে, মা আর কিছুক্ষন পরই ফিরে আসবে। কাঁদতে কাঁদতে সে এক সময় ঘুমায় পরে। সোনিয়ার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করেন এমন অভিযোগ সোনিয়ার পিতা কাশেম আলী শেখ মিঠুর। ঘটনার পর থেকে স্বামী আঃ রহিম, শ্বাশুড়ী আকলিমাসহ পরিবার পরিজন নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। সাথে দুধের বাচ্চা রোদেলাকে নিয়ে। রোববার সকালে নগরীর জোরাগেট সিএন্ডবি কলনীতে এ ঘটনা ঘটে।
সোনাডাঙ্গা মডেল থানার এসআই হরষিৎ মন্ডল জানান, সোনিয়ার শ্বশুর বাড়ী সিএন্ডবি কলনীতে গেলে মৃতের স্বামী আব্দুর রহিমসহ শ্ব্শুর বাড়ির সবাই পালিয়ে গেছেন। ঘটনাস্থলে এসে দেখি দরজায় তালা মারা। এখান থেকে সোনিয়াকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন প্রতিবেশিকে সোনিয়ার শ্বশুর বাড়ি লোকজন বলে সে স্টোক করেছে।
খুমেক হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিট-২ এর ইনচার্জ সিনিয়ার স্টাফ নার্স কারিমা খাতুন বলেন, মরিয়মকে যখন আনা হয় তখন বিষ পান করায় অবস্থায় ছিল। বিষয়টি রোগীর আত্মীয়রা গোপন রেখে জ্বর ও সর্দি কথা উল্লেখ করেন। যখন ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করতে যান, তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। মরিয়মকে আইসিইউতে রেফার্ড করা হয়। সেখানে নিতে নিতে সে মারা যায়। তিনি বলেন, রোগীর আত্মীয়রা যদি বিষ পান করার বিষয়টি গোপন না রাখতেন তাহলে তাকে তাৎক্ষনিক সঠিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে বাচানো সম্ভব হতো বলে তিনি মনে করেন।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোববার সকাল সোয়া ৯টার দিকে সর্দি-জ্বরজনিত কথা বলে মরিয়ম আক্তার সোনিয়াকে মেডিসিন ইউনিট-২ এর ৭-৮ ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সোনিয়ার স্বামী আঃ রমিহ ও তার শ্বাশুড়ী আকলিমা চিকিৎসকদের জানান, তার কয়েকদিন ধরে সর্দি ও জ্বরে ভুগছেন। হাসপাতালে যখন ওয়ার্ডে নেয়া হয়, তখন চিকিৎসকরা পরীক্ষার করার পর জানতে পারেন মেয়েটি বিষ খাওয়া। ওই সময় সে বিষ পান করা ছিল আগে থেকে বললে হয়তো তাকে বাঁচানোর সম্ভব হতো। ততক্ষুনে দেরি হয়ে গেছে। তার অবস্থা অবনতি হলে হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়ার আগেই মারা যান। সেখানে দুপুর ২টা ৫ মিনিটে মারা যায়। তার মৃত্যুর পর স্বামী আব্দুর রহিম পালিয়ে যান।
মৃত সোনিয়ার বাবা কাশেম আলী শেখ মিঠু বলেন, তিন মেয়ের মধ্যে মরিয়ম আক্তার সোনিয়া বড়। ২০০৯ সালে তার মেয়ে পালিয়ে গিয়ে আঃ রহিমকে বিয়ে করেন। মৃত্যুর ৫-৬ দিন আগে তার মেয়ে সোনিয়া শেষ বারের মতো তাকে ফোন করেন। এ সময় সে জানায়, আব্বু তুমি কি আমার পরে রাগ করে আছো’ আমি যদি চলে আসি তাহলে আমাকে থাকতে দেবে’। মেয়ে কান্না কন্ঠে শুনে বাবা মিঠু বলেন, তুইতো আমারই মেয়ে। তুই চলে আয়, যতদিন থাকতে মনচায় ততদিন আমার কাছেই থাকবি। এটাই তার মেয়ের সাথে শেষ কথা। মেয়ের বাবা মিঠু জানান, রোববার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সিএন্ডবি কলোনীতে এক প্রতিবেশী তার মাকে ফোনে জানায় আপনার মেয়ে খুবই অসুস্থ, খুমেক হাসপাতালে ভর্তি। তখনই মেয়ের মা মনোয়ার বেগম হাসপাতালে ছুটে আসেন।
মেয়ের মা মনোয়া বেগম জানান, হাসপাতালে আসার পর মেয়ের কি হইছে এমন প্রশ্ন করেন মেয়ের শ্বাশুরী আকলিমার কাছে। তখন সে জানায় সর্দি ও জ্বর হইছে। মেয়ের মুখ দিয়ে যখন গ্যাজা বের হচ্ছিল তখন তিনি বলেন মেয়ের তো জ্বর হয়নি। আপনারা মিথ্যা বলছেন। আপনারা আমার মেয়েকে বিষ খাইয়ে এখানে নিয়ে আসছেন।
মৃত সোনিয়ার শ্বাশুড়ী আকলিমা হাসপাতালে এ প্রতিবেদককে বলেন, কয়েকদিন ধরে বউমা অসুস্থ। জ্বর ও সর্দি ছিল। হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এখানে ভর্তি করা হয়। বিষ পান করার বিষয় তিনি অস্বীকার করেন। তার ছেলে আঃ রহিম কোথায় অবস্থান করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোথায় গেছে জানি না।
হাসপাতালে জরুরী বিভাগে ভর্তি রেজিস্ট্রি খাতায় উল্লেখ করা হয়, ভর্তি সকাল ৯টা ১৫ মিনিট। মরিয়ম আক্তার (২৮)। স্বামী আঃ রহিম। মোড়লগঞ্জ বাগেরহাট। (যার রেজি নং ১১৫১৯/৯)। রোগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ঋবাবৎ । মেডিসিন ইউনিট-২ এর ৭-৮ ওয়ার্ডে ভর্তি কথায় উল্লেখ করা মরিয়ম (২৮)। স্বামী আঃ রহিম। সিং মোড়, মোড়লগঞ্জ বাগেরহাট। প্রথমে ভর্তি খাতায় ঋবাবৎ উল্লেখ থাকলে পরে চিকিৎসক পরীক্ষার পর বুঝতে পারেন সে বিষ পান করা। তখন ঋবাবৎ কেটে দিয়ে ড়ঢ়প ঢ়ড়রংরহম (বঃ খাওয়া)। মৃত্যৃর সময় উল্লেখ করা হয় (ওঈট ফধঃয ২.৫ ঢ়স)।
ওই ওয়ার্ডে কর্তব্যরত নার্সরা জানান, যখন তাকে ভর্তি করা হয়। তখন রোগীর আত্মীয় স্বজনরা জানিয়েছিল তার সর্দি ও জ্বর। যখন চিকিৎসক তাকে দেখে পরীক্ষা করেন তখন জানা গেছে সে বিষ পান করা। রোগীর আত্মীয় স্বজন যদি গোপন না করতো তাহলে তাকে বাচানো সম্ভব হতো। কিন্তু তার আগে দেরি হয়ে গেছে।
রোববার বিকেলে মৃত সোনিয়ার শ্বশুর বাড়ি নগরীর সিএন্ডবি কলোনীতে গেলে দেখা যায় তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন ঘরে তালা মেরে পালিয়ে গেছে। পুলিশও ওই সময় ঘটনাস্থলে তদন্ত করতে আসেন। ওই এলাকার বাসিন্দা আঃ হাকিমের পুত্র আব্দুর রহিম দীর্ঘ ১২-১৫ বছর ধরে বসাবস করেন। প্রতিবেশিরা জানান, যখন রোদেলার মা সোনিয়াকে তার শ্বাশুরি আকলিমা ও তার স্বামী আঃ রহিম ও স্থানীয় এক মহিলা মরিয়ম যখন ভ্যানে করে নিয়ে যান তখন তারা বলেন, সোনিয়া স্টক করেছে। তাই তাকে খুমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একাধিক স্থাণীয় বাসিন্দারা জানান, সোনিয়া তার স্বামীকে আঃ রহিমকে ভালবেসে বিয়ে করেন। মৃতের ৫-৬ দিন আগে সোনিয়া তাদেরকে বলেন, তার স্বামী আঃ রহিম বিয়ে করেছেন। সেই মেয়েটি গর্ভবতী রয়েছে। এই নিয়েই তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। আঃ রহিম আন্দিও ঘাট এলাকায় চিপস এর মিল রয়েছে। সেখানে সে কাজ করেন।
মৃত সোনিয়ার মেঝ বোন জিনিয়া বলেন, তার বড় বোন সোনিয়া ২০০৯ সালে পাইনিয়ার কলেজ থেকে একাউন্টি বিষয় নিয়ে এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই সে আঃ রহিমের সাথে প্রেম করে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। বোনের শিশু কন্যা রোদেলা জন্মের পর থেকে মায়ের বুকের দুধ পান করতো। তিনি বলেন, আমার বোনের স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন বিষ পান করিয়ে হত্যা করেছেন। তার বোনের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন।
মেয়ের বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী কাশেম আলী শেখ মিঠু বলেন, আমার মেয়ে যে নির্যাতনের শিকার হতো বিষয়টি আমি ৫-৬ দিন আগ মেয়ে যখন তাকে ফোন করে তা কথায় বুঝতে পারি। আমার মেয়েকে তারা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে।
ভিডিও
https://youtu.be/Nny1tW5ZnSY