আজগর হোসেন ছাব্বির, দাকোপঃ খুলনার দূর্যোগ প্রবন উপজেলা দাকোপের কামারখোলা ইউনিয়নে সম্ভবনাময় কামারগোদা খালের মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্টির আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বাঁধা প্রভাবশালী মহলের লোভনীয় দৃষ্টি থেকে খালটি রক্ষা করে মিষ্টি পানির আধার ধরে রাখা। বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী ইজারা বাতিল করে খাল উন্মুক্ত রাখার দাবীতে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করেছে।
এক সময় কৃষি এবং মৎস্য চাষের জোন হিসাবে পরিচিত দক্ষিণ খুলনার উপকুলিয় উপজেলা দাকোপ বর্তমানে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কর্মহীন এলাকায় পরিনত হয়েছে। জীবিকার তাগিদে এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এখন কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিগত ২৫ মে ২০০৯ আইলার প্রভাবে দাকোপের বিধ্বস্ত অর্থনীতির চাকা সচল করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। আইলায় দীর্ঘ ২১ মাস পানিবন্দি অবস্থায় থাকায় উপজেলার কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়নে আজও ফিরে আসেনি কর্ম পরিবেশ। এখানকার চাষাবাদের জমি গুলো পলি পড়ে কোথাও বেশী উচু আবার কোন কোন এলাকায় ওই সময়ের পানি সরবরাহের ফলে অধীক নিচু হয়ে আছে। পাশাপাশি লবনাক্ত আবহাওয়া এবং পানি সংকটের কারনে ২টি ইউনিয়নের কৃষি ও মৎস্য সেক্টর অপুরনীয় ক্ষতির সম্মুক্ষিন। কামারখোলা ইউনিয়নের একটি মাত্র খাল কামারগোদা খাল নামে যেটি পরিচিত, সেটি এখন মিষ্টি পানির আধার। ওই খালের পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে কৃষি এবং মৎস্য চাষের মাধ্যমে এলাকার আর্থ সামাজিক খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে এমন ধারনা এলাকাবাসীর। ওই খাল সংলগ্ন এলাকায় বেসরকারী সংস্থা জেজেএস রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের মাধ্যমে মৎস্য এবং সব্জি চাষে জনসাধারনকে উৎসাহিত করতে পাইলট প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। তাছাড়া বিভিন্ন রাস্তার দু’ধারে তারা বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। গত ২১ আগষ্ট ওই প্রকল্পের উপজেলা পর্যায়ের এক সভায় সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান পঞ্চানন মন্ডল এবং এলাকার চাষি প্রতিনিধিরা ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে কামারগোদা খাল অবমুক্ত রাখতে প্রশাসনের নিকট দাবী তোলেন।
তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ নভেম্বর শুক্রবার বিকালে ইজারা প্রথা বাতিল করে কামারগোদা খাল অবমুক্ত করার দাবীতে জয়নগর বাঁধে স্থানীয় এলাকাবাসীর উদ্যোগে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান পঞ্চানন মন্ডলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন কামারখোলা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান উপজেলা আ’লীগের সহসভাপতি দীপংকর রায়, উপজেলা আ’লীগের সহসভাপতি সমরেশ ঘরামী, ইউনিয়ন আ’লীগ সভাপতি হিমাংশু সরকার, অরবিন্দু সরদার, অত্র ইউপি সদস্য আঃ সাত্তার সানা, মনিরুল শিকদার, সুশংকর বাছাড়, ননীগোপাল মাঝি, সুজিত রায়, রফিকুল ইসলাম ছোট্র, রাজ্জাক গাজী, স্বপন বাছাড়, সুধারানী জোয়াদ্দার, বিথীকা রায়, কৃষক প্রবীর মোড়ল, দীপক রায়, পংকজ মন্ডল, রনজিত মন্ডল, মোজাফ্ফার সানা, শশাংক রায়, হিমাংশু রায় প্রমুখ। সমাবেশে অভিযোগ করে বলা হয় আদালতে বিচারাধীন বিষয় থাকা সত্বেও জনৈক লতিফকে সামনে রেখে প্রভাবশালী বহিরাগত মহল খাল দখলের পায়তারা করছে। তারা যে কোন মুল্যে ওই খালকে উন্মুক্ত রাখতে প্রয়োজনে গন আন্দোলনে নামার হুশিয়ারী উচ্চারন করেন।
এলাকাবাসীর এমন অভিপ্রায়ে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে গিয়ে জানা যায়, বর্তমানে প্রভাবশালী মহল খালের একাধীক স্থানে বেআইনীভাবে নেটপাটা দিয়ে পানি সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করেছে। এই কামারগোদা খালকে প্রভাবশালীদের কবল থেকে দখলমুক্ত রেখে অবাধ পানি প্রাপ্তির পরিবেশ সৃষ্টিতে বদলে যেতে পারে সেখানকার ৬ গ্রামের প্রায় ১ হাজার কৃষকের ভাগ্যে বদলের চাকা। এ কামারগোদা খালটি শুরুতে ৭৪ একর জমিতে খালের পরিধি থাকলেও আইলার প্রভাবে সেটি এখন ২৮০ একরে এসে দাড়িয়েছে। ওই এলাকার চাষি কৃষ্ণপদ ঘরামী, দেদব্রত মন্ডল, প্রভাষ মন্ডল, মঙ্গলকৃষ্ণ মন্ডল, সন্তোষ মন্ডল জানায়, আইলার পর থেকে কেবল মাত্র আমন চাষের উপর নির্ভরশীল থেকে আমরা কোন রকম জীবন ধারন করে বেঁচে আছি। কিন্তু গত বছর এই কামারগোদা নদীর মিষ্টি পানি ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে বিভিন্ন এনজিও’র উৎসাহে আমনের পাশাপাশি বোরো ধান, তরমুজ, মিষ্টি কুমড়ো, উচতে, বাঙ্গি, ঢেড়শসহ অন্যান্য সব্জির চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছি। যে কারনে এখন অনেকেই ওই সমস্ত চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাঁধা খালের পানির অবাধ ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়া। একই সাথে গরমের মৌসুমে অন্তত দুই মাস অনেকে এই খালের পানি খেয়ে জীবন ধারন করে। আমরা যে কোন মুল্যে এই খাল অবমুক্ত রাখতে অঙ্গিবারাবদ্ধ। দেখা যায় খালের একটি অংশে জনৈক আঃ লতিফ আড়াআড়ি নেটপাটা দিয়ে নিজেদের দখলে নিয়ে মাছ চাষ করছে। জানা যায় ওই অংশে দখলদারের রেকর্ডিয় জমি ভেঙ্গে খালের ভিতর চলে গেছে। বাকী অংশ আপাতাত উন্মুক্ত থাকলেও বর্তমানে প্রভাবশালী একাধীক মহল ওই খালের দখল পেতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে।
সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে গত ২১ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সংসদ সদস্য পঞ্চানন বিশ্বাস ওই খালে ৭২২ কেজি মাছের পোনা অবমুক্ত করেছেন। ২০১১ সালে তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান উমাশংকর রায় ওই খালের ইজারা বন্দ করে জনস্বার্থে উন্মুক্ত রাখার দাবীতে একটি মামলা দায়ের করেন। ৫ বছর পর ওই মামলায় গত ২৭ মার্চ রায় দেওয়া হয়। রায় বিপক্ষে যাওয়ায় বাদী ফের খুলনার বিজ্ঞ জজ আদালতে আপিল করেছেন। এলাকায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে ২৭ মার্চের রায়ের আগে ২২ মার্চ কিভাবে ওই খালের ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়? এ প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে দাকোপ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মারুফুল আলম সম্প্রতি ওইখাল পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার শতাধীক কৃষকের সাথে কথা বলেন, তিনি খালে আড়াআড়ি নেটপাটা ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, কারো জমি খালের মধ্যে আসলে তিনি কেবল সেই অংশে নেটপাটা দিতে পারেন, কিন্তু পুরো খাল এভাবে আটকে দেওয়ার কোন অধিকার কারো নেই। তিনি এলাকার দরিদ্র কৃষকদের জন্য খালের পানি অবমুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান পঞ্চানন মন্ডল বলেন, অভাবের তাড়নায় আমার ইউনিয়নের মানুষ এখন শ্রম বিক্রি করতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাজের সন্ধানে। অথচ এই খাল যদি আমরা অবমুক্ত রাখতে পারি তাহলে ৬ গ্রামের সহ¯্রাধীক পরিবার এর উপর জীবিকা নির্বাহ করে বেঁচে থাকতে পারে। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, খাল ইজারার মাধ্যমে কৃষকের পানি প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা হলে রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষ সংঘাত হতে পারে।