ইউনিক ডেস্ক : খুলনা-১ আসন আওয়ামীলীগের ঘাটি হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে চিহ্নিত। এক সময়ে এ আসনটিতে ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভোটারদের আধিক্য। বটিয়াঘাটা এবং দাকোপ উপজেলা নিয়ে আসনটি গঠিত। দাকোপ উপজেলায় ৯টি ও বটিয়াঘাটায় ৭টি ইউনিয়ন এবং চালনা পৌরসভা মিলে এ আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৮২ হাজার ৪৮৩ জন। খুলনা শহর সংলগ্ন বটিয়াঘাটা এবং পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ঘেঁষা দাকোপ। দক্ষিণের এই জনপদে আসনটিতে ইতোমধ্যে জোরেসোরে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের নিশ্চিত আসন হওয়ায় এখানে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন অনেকেই। তবে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙ্গণ ও নোনা পানির সাথে বসবাস করা মানুষের আক্ষেপেরও শেষ নাই। খুলনা বিভাগীয় শহরের নিকটতম এ উপজেলা দু’টিতে উন্নয়নের ছোঁয়া নিয়ে ক্ষোভ, দু:খ-হতাশা রয়েছে সর্বস্তরের মানুষের।
জাতীয় সংসদের ৯৯ নম্বর আসন খুলনা-১। বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) হুইপ পঞ্চানন বিশ্বাস। এর আগে ১৯৯১ সালে এই আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হারুনুর রশিদ। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথমবার এমপি হন পঞ্চানন বিশ্বাস। তবে সেবার দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন তিনি। দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন শেখ হারুনুর রশিদ। সে সময় বলা হয়, হিন্দু ধর্মালম্বীদের মুখপাত্র হিসেবেই তিনি বিজয়ী হয়েছেন।
এরপরে ২০০১ সালে এবং ২০১৪ সালে পঞ্চানন বিশ্বাস আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে আবার এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে পঞ্চানন বিশ্বাস ৬৬ হাজার ৯০৪ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থী ২০০৮এ নির্বাচিত এমপি ননীগোপাল মন্ডল। তিনি পেয়েছিলেন ৩৪ হাজার ৫২৭ ভোট। এর আগে ২০০৮ -এর নির্বাচনে এই আসন হতে ননীগোপাল মন্ডল পেয়েছিলেন এক লাখ ২০ হাজার ৮০১ ভোট। তখন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী আমীর এজাজ খানের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৮ হাজার ৪০২।
সবশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-১ আসনের ১০৭টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের পঞ্চানন বিশ্বাস এক লাখ ৭২ হাজার ৫৯ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আমীর এজাজ খান পেয়েছিলেন ২৮ হাজার ৪৩৭ ভোট। নির্বাচনের ময়দানে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন, জাতীয় পার্টির সুনীল শুভ রায়, সিপিবির অশোক কুমার সরকার এবং ইমলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আবু সাঈদ। আর স্বাধীনতার পর আসনটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের এম এ খায়ের, ১৯৭৯ সালে বিএনপির সৈয়দ মোজাহিদুর রহমান, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের শেখ হারুনুর রশিদ, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির শেখ আবুল হোসেন বিজয়ী হয়েছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি হয়েছিলে বিএনপির প্রফুল্ল কুমার মন্ডল। বর্তমানে (২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত) এই আসনে ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৮২ হাজার ৪৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৪১ হাজার ৪২৭ ও নারী ভোটার এক লাখ ৪১ হাজার ৫৬ জন।
এলাকাবাসী জানায়, একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত সংসদ সদস্য পঞ্চানন বিশ্বাস ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে অনেকটা স্বচ্ছ। তবে এলাকার নানা স্তরের মানুষের ক্ষোভও বিস্তর। এই ক্ষোভের কারণ, দুর্যোগে-দুর্ভোগে ভোগা মানুষগুলোর জন্যে যথাসময়ে কিছু করতে না পারা। তৃণমূলের মানুষের অভিযোগ একজন হুইপ চাইলে দৃশ্যমান বহু উন্নয়ন সম্ভব ছিল। এলাকাবাসী আরও জানায়, ক্ষমতাশীনদের ঘরের মধ্যে অনেক কোন্দল রয়েছে; সেগুলো আগে মিটাতে হবে। তাছাড়া এ আসনের পরিবেশ এখন আর আগের মত নেই। ভোটার সংখ্যা এখন পাল্টে গেছে। সেক্ষেত্রে ফেয়ার নির্বাচনে উপযুক্ত প্রার্থী না হলে এ ঘাটিতে পরিবর্তন আসতে পারে।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, আগামী নির্বাচনে পঞ্চানন বিশ্বাস ছাড়াও আরও সাত জন দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন। এরা হলেন, সাবেক এমপি ননীগোপাল মন্ডল, বর্তমান স্থানীয় সংরক্ষিত নারী এমপি এ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, বটিয়াঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম খান, বিসিবির পরিচালক ও বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্র শেখ সোহেল, দাকোপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবুল হোসেন, প্রাক্তন সচিব ড. প্রশান্ত কুমার রায় এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক শ্রীমন্ত অধিকারী রাহুল। জানা যায়, এ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়ায় বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। এছাড়া তিনি দেশের প্রথম ক্যাথলিক খ্রিষ্টান নারী এমপি। তবে নির্বাচনের মাঠ এখন রয়েছে আশরাফুল আলম খান এর দখলে। প্রচার-প্রচারণা এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি রয়েছেন এগিয়ে।
তবে এই আসনে বলতে গেলে একক প্রার্থী নিয়ে স্বস্তিতে আছেন বিএনপি। ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালে পরাজিত হলেও লেগে থেকে এই আসনে বরাবরই নির্বাচন করেন খুলনা জেলা শাখার বর্তমান আহবায়ক আমির এজাজ খান। এছাড়া বর্তমান সংসদের বিরোধী দল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির প্রার্থীর প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। ২০১৮ সালেও তিনি নির্বাচন করেছিলেন। আর সিপিবির জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ও বটিয়াঘাটা উপজেলার সভাপতি অশোক কুমার সরকার এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা কমিটির সহ-সভাপতি মাওলানা আবু সাঈদ গতবারের মতোই প্রার্থী হচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
পঞ্চানন বিশ্বাস বলেন, একজন এমপি হিসেবে যতটুকু করা যেতে পারে, তিনি ততটুকু করার চেষ্টা করেছেন। তাই তিনি যেমন মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী, তেমনি এলাকাবাসীও তাকে নির্বাচিত করবেন বলে তিনি যথেষ্ট আশাবাদী।
মনোনয়ন প্রত্যাশী ননীগোপাল মন্ডল জানান, আমি আশাকরি দল এবার আমাকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নেবে। কেননা ২০০৮ সালে আমি এমপি হওয়ার পর অবহেলিত এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করেছি। তিনি আরও বলেন, আমি আগামীতে নির্বাচিত হলে দাকোপ-বটিয়াঘাটায় কৃষি ও যোগাযোগে বিপ্লব ঘটাতে চাই।
আশরাফুল আলম খান বলেন, সততার সাথে মানুষের কল্যাণে কাজ করে চলেছি। মানুষের ভালোবাসায় পর পর তিন বার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। দল মনোনয়ন দিলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হবো। বটিয়াঘাটা দাকোপের দৃশ্যমান উন্নয়নে নিজেকে নিবেদিত রাখবো।
অপরদিকে আমীর এজাজ খান বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ যদি থাকে এবং দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় তাহলে অবশ্যই আমি নির্বাচনে অংশ নেবো। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে আমি জয়লাভ করবো।
জানা যায় এক সময়ে এ আসন হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে বিগত নির্বাচনের সময় থেকে সে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে এ আসনে হিন্দু ভোটারের চেয়ে মুসলিম ভোটার কয়েকগুণ বেশী। ১৯৮৮ সালে এরশাদের নির্বাচন এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছাড়া বাকী নির্বাচনে এই আসনের ভোটাররা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে কখনও ভোট দিতে ভোলেনি।