চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষই ধ্বংস করছে কর্ণফুলী নদী!

প্রকাশঃ ২০২০-০৯-২২ - ০২:৫২

বিপ্লব দে,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী ভরাট ও দখলের জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী শাহ আমানত ব্রিজে ৮৬৬ মিটার প্রস্থের কর্ণফুলী নদী এখন ৪১০ মিটার। বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদী খনন না করায় চাক্তাই, রাজাখালী খালের মোহনা ভরাট হয়ে গেছে। যে কারণে চাক্তাই থেকে বহদ্দার হাট মোড় পর্যন্ত জলাবন্ধতা যেনো লেগেই অাছে। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন কমিটি আজ ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এইসব কথা বলেন।

জানা যায়, প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী শাহ আমানত ব্রিজ এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ৪১০ ফুট হওয়ায় ধ্বংসে পড়তে পারে সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত। কর্ণফুলী রক্ষায় মহাপরিকল্পনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১,৭৩,২৬৩ বর্গফুট নদী মৎস্য সমিতিকে লিজ দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। মাস্টার প্ল্যান বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে বন্দর ধ্বংস করছে কর্ণফুলী নদী।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর বন্দর শাসিত এলাকা হালদা মোহনা থেকে কর্ণফুলী মোহনা পর্যন্ত ১০ মাইল কর্ণফুলী রক্ষায় ২০১৪ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তপক্ষ “স্ট্রাটেজিক মাস্টার প্ল্যান ফর চিটাগাং পোর্ট” শীর্ষক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিএস জরিপ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ঠিক রেখেই সেই পরিকল্পনা করা হয়।

বন্দরের স্বাভাবিক গতিশীলতা ও কর্ণফুলীর নাব্যতা রক্ষায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প নাই। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশী মতো নদী লিজ দিয়ে কর্ণফুলী সর্বনাশ করেছে। বন্দর কর্তৃক নিজেদের ব্যবহৃত অংশে কর্ণফুলী নদী খনন, শাসন ও উভয়তীরে সীমানা প্রাচীর না দেয়ায় কর্ণফুলী স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ধ্বংস হয়েছে।

বিগত ২১ দিন ব্যাপী চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন কর্ণফুলী নদীর শাহআমানত ব্রিজ থেকে ফিরিঙ্গিবাজার মনোহর খালী পর্যন্ত কর্ণফুলী প্রস্থ জরিপ করেছে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন। উক্ত জরিপে কর্ণফুলীর দখল ও ভরাট হওয়ায় ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।

জরীপে দেখা যায়, কর্ণফুলী ব্রিজ নির্মানের সময় এডিবি মাস্টার প্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী কর্ণফুলী দৈর্ঘ্য ছিল ৮৮৬.১৬ মিটার।

কিন্তু! আমাদের জরিপে দেখা যায়, শাহা আমানত সেতুর নিচে বর্তমানে কর্ণফুলী নদী ভাটার সময় প্রস্থ মাত্র ৪১০ মিটার। জোয়ারের সময় চর অতিক্রম করে ৫১০ মিটার পর্যন্ত জোয়ারের পানি আসে। ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেই অংশে কোন প্রকার নৌযান চলাচল করেনা। নদী ভরাট হওয়ায় শাহ আমানত সেতুর মাঝ পিলারের পাশে অঘোষিত একটি যাত্রী পারাপার ঘাট তৈরি করেছে স্থানীয়রা। জোয়ার ভাটার সময় লিংক রোড থেকে অর্থ কিলোমিটার নদীর অংশ পায়ে হেটে যাত্রীরা ব্রিজের নিচে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে এসে সাম্পানে উঠে।

চাক্তাই খালের মুখে এসে বিএস সিট ও এডিপি মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী নদীর প্রস্থ ৯৮২ মিটার। বাস্তবে ৫১০ মিটার নদী রয়েছে। এর পর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্মিত মেরিনার্স পার্ক এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ৯৮১ মিটার। বন্দর কতৃপক্ষ বর্তমানে সেই অংশে খনন করেছে। খননের পর নদীর প্রস্থ দাড়িয়ে মাত্র ৮৫০ মিটার। এরপর ফিরিঙ্গি বাজার মোড়ে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ৯০৪ মিটার। বর্তমানে বন্দর খনন করার পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার। বাকি অংশ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মান করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে।

পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, কর্ণফুলী ব্রিজের উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার কর্ণফুলী নদী ভরাট হওয়ায় জোয়ার ভাটার সময় সেখানে ব্যাপক নদীর স্রোত হয়। স্রোতের স্রোতের এই তীব্রতার চাপ কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্তে শাহ আমানত ব্রিজের সংযোগ সড়কের বর্ধিত অংশ ও দুই পিলারে পড়ছে। যা শাহা আমানত সেতুর জন্য বিপজ্জনক। বন্যা বা সাইক্লোন হলে শাহ আমানত ব্রিজের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রাজাখালী খাল ও চাক্তাই খালের মোহনা কর্ণফুলী সেতুর মাঝ বরাবর সংযুক্ত হয়েছে। বৃষ্টি বা নদীতে জোয়ারের উচ্চতা বাড়লে ছোট কর্ণফুলী অংশের প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। যে কারণে চট্টগ্রাম নগরী থেকে চাক্তাই ও রাজাখালী খালে প্রবাহিত পানি নদীতে আসতে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে শুরু করে বহদ্দার মোড় পর্যন্ত জলাবন্ধতার সৃষ্টি হয়।

জরিপে প্রতিফলিত হয়, কর্ণফুলী ব্রিজের পশ্চিম পাশে রাজখালী খালের পাশে বেড়ামার্কেট বস্তি, রাজাখালী ও চাক্তাই খালের সংযোগস্থলে সোনালী মৎস আড়ৎ, চাক্তাই খালের পশ্চিম পাড় থেকে ফিরিঙ্গিবাজার পর্যন্ত মেরিন ফিশারিজ পার্ক সম্পূর্ণ কর্ণফুলী দখল করে গড়ে উঠেছে। এডিবি মাস্টার প্ল্যানে এই সমস্থ মার্কেটের অস্থিত্ব নাই। সেখানে নদী দেখানো হয়েছে। বন্দরের স্বাভাবিক গতি প্রবাহ, কর্ণফুলী ব্রিজ রক্ষা ও চাক্তাই খাতুনগঞ্জসহ নগরীর বিস্তৃর্ণ এলাকা নিয়মিত প্লাবন থেকে রক্ষা করতে এবং কর্ণফুলীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ রক্ষা করতে এইসব স্থাপনা উচ্ছেদ করে মেরিন সড়ককে কর্ণফুলীর তীর ধরে তা গাইড ওয়াল তৈরি করা জরুরি।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন, নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভারপ্রাপ্ত প্রো-ভিসি অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হালদা গবেষক মঞ্জরুল কিবরিয়া, কর্ণফুলী গবেষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী, জাইকা ও ডিএফআইড এর সাবেক পরিবেশ কনসালটেন্ট অধ্যাপক নোমা আহমাদ সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাশ, সদস্য অধ্যাপক মনোজ কুমার দেব প্রমুখ।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার জানান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্নফুলী নদীর ভূমি ভোগদখল করতে পারবে, কিন্তু তারা অন্য কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিতে পারে না। আমরা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে কর্ণফুলী নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি দেখেছি।