চট্টগ্রামে বেতের ৫ বাড়িতে হল কলেজছাত্রী ধর্ষণচেষ্টার ‘বিচার’

প্রকাশঃ ২০২০-১২-০৬ - ০১:৫৫

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফলপ্রার্থী তিশা। বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। থাকেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বাবা-মায়ের সাথেই। কলেজ ও কোচিংয়ে আসা-যাওয়ার পথে তাকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতো স্থানীয় বখাটে দেলোয়ার। কিন্তু এতেও ‘স্বাদ’ মিটেনি তার। গত ২৬ নভেম্বর তিশার ঘরের সামনেই হাজির হয় সে। ঘরে লোকজন না থাকার সুযোগ নিয়ে দরজা ভেঙে ঢুকে তিশাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে দেলোয়ার। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে।

ঘটনার পরপর জাতীয় সেবা হটলাইন-৯৯৯ এ কল করে জানানো হয়। পুলিশও আসে ঘটনাস্থলে। পুলিশের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগীকে অভিযোগ দিতে বলা হয় থানায়। কিন্তু বাধ সাধে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনির আহম্মদ ও সাবেক সদস্য আজগর আলী।

ঘটনা ধামাচাপা দিতে দেলোয়ারের পক্ষ নেয় এ দুই জন। থানায় অভিযোগ কিংবা মামলা না করতে ভুক্তভোগীকে ‘পরামর্শ’ দেয় তারা। ধর্ষণ চেষ্টার মত ফৌজদারী অপরাধের ‘লোক দেখানো’ বিচারেরও আয়োজন করে চেয়ারম্যান তার বাড়িতে। মাত্র পাঁচটি বেত্রাঘাত করেই ধর্ষণচেষ্টার মত গুরুতর অপরাধের বিচার রাতের আঁধারে সেরে ফেলা হয় গত ৩ ডিসেম্বর।

বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে নয়টার দিকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে পূর্ব নির্ধারিত সালিশি বৈঠকে এ বিচার করা হয়। অভিযুক্ত মো. দেলোয়ার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার হাফিজ জুট মিলস ফুলতলা কলোনী গেইট এলাকার মোহাম্মদ নুরের সন্তান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গত ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিশার পরিবারের লোকজন বাসায়় না থাকার সুযোগ নেয় দেলোয়ার। দেলোয়ার ওইদিন তিশার বাড়িতে গিয়ে দরজা খুলতে বলে। কিন্তু ভেতর থেকে তিশা দরজা না খুললে লাথি মেরে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে দেলোয়ার। এ সময় তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা। পরে তিশা ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে আসে। এ সময় রাস্তার উপর তাকে মারধরও করে দেলোয়ার। একপর্যায়ে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে পালিয়ে যায় দেলোয়ার।

ভুক্তভোগী নারী তিশা বলেন, ‘আমাদের বাড়ি নোয়াখালী। আমি হাফিজ জুট মিলসের ফুলতলা কলোনীতে পরিবারের সঙ্গে অস্থায়ীভানে বসবাস করছি। আমি এবার এইচএস ফলপ্রার্থী। দেলোয়ার আমাকে দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে ও কোচিংয়ে যাওয়া-আসার পথে উত্ত্যক্ত করতো। গত ২৬ নভেম্বর আমার পরিবারের লোকজন বেড়াতে যায়। আমি বাসায় একাই ছিলাম। সন্ধ্যার সাতটার খালি বাসার সুযোগ পেয়ে দেলোয়ার আমার বাসায় এসেই লাথি মেরে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলে। ঘরে প্রবেশ করেই সে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। আমি এ সময় ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে রাস্তায় চলে আসি। সেখানেও দেলোয়ার গিয়ে আমাকে মারধর করে। এলাকার লোকজন সেখানে জড়ো হলে সে পালিয়ে যায়। এরপর ৯৯৯ লাইনে ফোন করলে থানা থেকে পুলিশ আসে ঘটনাস্থলে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনার পর সাবেক সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আজগর আলী ও সোনাইছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মনির আহম্মদ বিষয়টি সমাধান করার আশ্বাস দেয় আমার পরিবারকে। এ জন্য থানায় আর যাইনি আমরা। গত বৃহস্পতিবার চেয়ারম্যান বাড়িতে এ বিষয়ে শালিশ হয়। সেখানে দেলোয়ারকে শালিশি বিচারকদের উপস্থিতিতে মাত্র পাঁচটি বেত্রাঘাত করে বিচার করা হয়।’

থানায় মামলা বা অভিযোগ কেন করেননি- জানতে চাইলে ভুক্তভোগী ওই নারী বলেন, ‘আমরা এখানে অস্থায়ীভাবে ভাড়ায় থাকি। মামলা করলে আমার উপর আরও নির্যাতন হতে পারে। সে ভয়ে থানায় যাইনি।’

বিচারের বিষয়ে সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির আহম্মদ বলেন, ‘আমি ওই ছেলেকে অভিযোগের বিষয়ে পাঁচটি বেত্রাঘাত করে সমাধান করেছি। তবে সেখানে ওই মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টার বিষয়ে কোনো বিচার করিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওই মেয়েকে থানায় না যাওয়ার বিষয়ে আমি কোনো কথা বলিনি।’

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড থানার পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রবি বলেন, ‘ওইদিন জাতীয় সেবা হটলাইন-৯৯৯ লাইনে ফোন করা হলে থানা থেকে আমাকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। ভূক্তভোগীর অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও আমরা পাই। ভুক্তভোগীকে আমরা থানায় অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিই। কিন্তু কেউ থানায় আসেনি। অভিযোগও দেয়নি।’

এ ঘটনায় অভিযুক্ত দেলোয়ারের মুঠোফোনে কল করা হলেও সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি।