করোনায় মৃত্যু হলে একসাথে মরবো-বাঁচলে একসাথে বাঁচবো

প্রকাশঃ ২০২১-০৭-১৩ - ১৯:০৭

মিজানুর রহমান মিজান : দিনটি ছিলো গত ২৭ জুন ২১ তারিখের ঘটনা। এই দিনটির ৩ দিন আগে ২৫ জুন হঠাৎ করে আমার জ্বর জ্বর ভাব, পেটে পিড়া দেয়। আমি হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়ি। নিজে নিজেকে নিয়ে ভয় পাই। আমি কিছুটা আড়ালে থাকতে চাই। হলোকি আমার মরনঘাতক করোনা! কিন্তু দাদা আমাকে রুমে না দেখে বারং বার আমাকে ডাকতে থাকেন। পরে আমি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি শুনে আমার শোয়ার রুমে আসেন। আমার সিমটম দেখে তিনি বুঝেই ফেলেন মরনঘাতক করোনার লক্ষন এটি। আমার মাথার পাশে দাদা দীর্ঘ দুই ঘন্টার মতন বসে আড্ডা দেয়। আমাকে সাহস দেন। প্রিয় মানুষটির সাথে ছিলেন প্রিয় মাতৃতুল্য দিদি(দাদার সহধর্মিণী), সাবেক ছাত্রনেতা সুমন ভাই ও স্নেহের ছোট ভাই শেখ ইব্রাহিম এবং বাপজান রুদ্র(দাদার সন্তান) ও ছোট বাবা রাতুল।
দিদি পেশায় একজন সিনিয়র নার্সিং সুপারভাইজার। সে অনেক অভিজ্ঞ। তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে টিটমেন্ট দেন। আমি রাত শেষে সকালে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠি। কিন্তু সর্দি,ঠান্ডা পিছু ছাড়ে না। দিদিও আমার সিমটম দেখে বলেই দেন করোনা হতে পারে। প্রেসারটা অনেক বেশি। দেন ঔষধ। বলেই দেন দাদাকে মিজানকে পরীক্ষা করাও, ও তোমরা করো।
২৭ জুন দাদা আমাকেসহ আমরা ৬জন বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে করোনার পরীক্ষা করাই। কর্তব্যরত চিকিৎসক রেজাল্ট দেন ২ জন করোনা পজেটিভ। বাকিরা নেগেটিভ। ভেঙ্গে পড়ি ভিতরে ভিতরে। কিন্তু দাদা যেন কষ্ট না পায় বা দাদার বয়স বেশি তিনি ভেঙ্গে পড়বেন ভেবে হাঁসি মুখে বলি- আরে কিছু হবে না আল্লাহর রহমতে। আমরা চিকিৎসা নিলে ঠিক হয়ে যাবো। আমি সবাইকে দাদাকে নিয়ে বাড়িতে চলে যেতে বললেই। দাদা আমাকে ধমক দিয়ে বলে এই বেশি বুইঝো না। তুমি আমার কাছে থাকবা। করোনায় আরে বাঁচলে এক সাথে বাঁচবো। আর মরলে দুই ভাই একসাথে মরবো। তুমি গাড়িতে উঠে পড়ো। আমার বাড়িতে যাবা। কথাটি শুনে ঐ সময় আমার চোঁখে পানি টলটল করছিলো। বিপদ যেনেও আমাকে নিজের বাড়িতে রাখবেন। সময় নষ্ট না করে উঠে পড়ি দাদার সাথে গাড়িতে।
ইতিমধ্যে সংবাদটি আমার পরিবারের কাছে পৌছানোর আগেই দাদার বাড়িতে পৌছায় জায়। বাড়িতে গিয়ে দেখি সবাই হতভম্ব। সবাই নিশ্চুপ! সবার চোঁখে,মুখে কি যেন শুন্যতা। মাতৃতুল্য দিদি হাঁসি মুখে বললেন-আরে কি হইছে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাদের রুম সুন্দর করে রেডি করে দিয়েছি। রুমে তোমরা চলে যাও। রুমে ঢুকতেই আমার মরহুম আম্মাজানের মুখখানি বারবার চোঁখ ভাসছিলো। মনে মনে ভাবছি- মাগো হয়তো দেখা হবে তোমার সাথে।
ড্রেস চেঞ্জ করে দুই ভাই কিছুটা চুপিসারে বসে মোবাইল চাপছি। ফেসবুকে সংবাদটি ছড়িয়েছে দ্রুত সময়ের মধ্যে। ফেসবুকের পাতায় ঢুকতেই দেখতে পারছি সবাই সাহস দিচ্ছেন কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজে আমিই সাহস করে দাদা ও আমি করোনা পজেটিভ বলে ফেসবুকের পাতায় লিখে দিলাম। মুহুর্তের মধ্যে বহু ভালোবাসার মানুষ খোজ খবর নিতে লাগলো, সাহস, পরামর্শ দিতে লাগলো। রাজনীতির বহুনেতা,শুভাকাঙ্ক্ষী এবং ভালোবাসার মানুষেরা খোঁজ খবর নিতে লাগলো।
রাত প্রায় ৮ টা বাজে। আমার সন্তান-স্ত্রী ফোনে কথা বলতেই তাদের কান্নার শব্দ শুনে নিজে আমি আরো দূর্বল হয়ে পড়লাম। ওদেরকে উল্টা সান্তনা দিয়ে ফোন কাটলাম। ওরা সবাই অবস্থান করছে ঢাকায়(আমার শশুড়ালয়ে)। আমার নিজের বাড়ি লোক শুন্য। ওরা খুব ভেঙ্গে পড়েছে এর মধ্যেই।
আমি দাদার দিকে তাকাতেই দেখি দাদার চোঁখে পানি। মাতৃতুল্য দিদি বসা আমাদের পাশে। সুমন ভাই, ইব্রাহিম রুমের দরজার সামনে। সবাই চুপ। যাই হোক ভিশন কষ্টময়,ঘুমহীন রাতটি গেলো। ২৮,২৯,৩০ তারিখে দেহে যন্ত্রণা,কাশি, জ্বর, পেটের পিড়া, গলায় ব্যাথা, কিছুটা শ্বাসে কষ্টসহ বিভিন্ন কষ্টে ভুগছি আমরা দুই ভাই। চিন্তা আর চিন্তা। যদি অবেলায় চলে যাই না ফেরার দেশে তয় কি হবে আমার ছোট দুটি সন্তান ও স্ত্রীর। কে দেখবে ওদের। আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আমার কোন পথ খোলা নেই। ঘুমহীন প্রতিটা রাত কাটে দাদার ও আমার।
দাদা আমাকে নিজের সন্তানের মতন খাবার থেকে শুরু করে নিয়ম মতন মেডিসিন খাওয়াতেন। আমি খেতে পারতাম না। তিনি ধমক দিয়ে খাওয়াতেন। স্নেহের হাতখানি বাবার মতন মাথার উপরে রাখতেন। তিনিও কিন্তু মারাত্মক অসুস্থ। দেহে যন্ত্রণা নিয়ে নিজের কথা ভুলে আমাকে সব সময় সাহস দিচ্ছেন। আমি রাতে ঘুমালে তিনি গায়ের কাতাটাও পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছেন। আমি অনেক সময় ঘুম পড়িনি। যন্ত্রণায়, দাদার দিকে তাকিয়ে দেখি দাদা সোফায় মাথাটি কাত করে রেখে- না ঘুমিয়ে কি যেন ভাবছেন। সম্ববত ১ জুলাই সকালে প্রতিদিনের ন্যায় রুটিন অনুযায়ী লেবুপানি রেডি করে রেখে- দাদার আঙ্গুলে অক্সিমিটার লাগিয়ে দিতেই দেখি ৯২/৯৩। কিছুটা ভয় পেলাম। দাদাকে বুঝতে দেইনি। এমন ২/৩ দিন হয়েছে আমার ও দাদার। সময় কেমন যেন কাটেনা। রাত,দিন শেষ হয় না। এ এক বন্দীময় জীবন। শুন্যতা আর শুন্যতা। কাকে বোঝাই কষ্ট গুলি। ঔষধ খেলে আর খিদা থাকে না। বহু পাওয়ারের ঔষধ। শরীর দূর্বল।
অন্যদিকে টিভি খুললেই খুলনায় মৃত্যুর মিছিল। মানুষের কষ্ট। কি যে একটা ব্যাথা, বলে বোঝাতে পারবো না। আরো ভয় কাজ করে টিভির সংবাদ দেখলে।
দেখতে দেখতে যন্ত্রণাময় ১০ দিন পর কিছুটা দেহে স্বস্তি আসলো। ১১ দিনে আমি খাবারে ঘ্রান পেলাম। দাদা তখনও কিন্তু পাইনি। কিন্তু দাদা আমার সুস্থতা দেখে প্রচন্ড খুশি। ১৩ দিনে দাদা খাবারের ঘ্রানটা পেলো। এ যেন ঈদের চাঁদ দেখার মতন আনন্দ আমাদের। মনটা দুই ভাইয়ের ভরে গেলো। যে ভালোবাসার মানুষটি ফোন দেয় তাকেই হাঁসিমাখা মুখে আনন্দের সংবাদটি বললে তারাও মহা খুশি হন। ১৪ দিন শেষে ১৫ দিন খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়, কেমন যেন আজ ঈদ। আমাদের এমন ভাবটি। গোসল করে রেডি, মাতৃতুল্য দিদি হাসপাতালের ডিউটিতে সকালে চলে গিয়েছেন, বড় বোন মেঝ বউদি(একজন সাদা মনের মানুষ) দু’তলায় ডাইনিং টেবিলে খাবার রেডি করে রেখেছেন। তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে বাড়ির সবার কাছ থেকে হাঁসিমুখে বিদায় নিলাম। দাদাতো মহাখুশি। আজ নেগেটিভ রেজাল্ট আসবে। কাল থেকে রাজনীতি, সামাজিক কাজে নেমে পড়তে পারবেন ও আমরা পারবো। যাই হোক বটিয়াঘাটা উপজেলায় পৌছাতে চোঁখে কেমন যেন সব কিছু নতুন নতুন মনে হলো। কেমন যেন কতকাল প্রানের উপজেলা পরিষদকে দেখি না। গেলাম হাসপাতালে। পরীক্ষা করালাম। কিছুক্ষণ পরে রেজাল্ট দিলো দাদা ও আমি এখন করোনা নেগেটিভ। সংবাদটি নিজেদেরকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন বুনন করলো।
আমাদের সাথে আরো প্রিয়জনেরা এক সাথে পরীক্ষা করালাম। তারাও নেগেটিভ। আরো আনন্দিত হলাম। সবাই সবাইকে ঘটে যাওয়া ১৪ দিনের ইতিহাস কম বেশি তুলে ধরে গল্প করে বিদায় নিলাম। উপস্থিত ছোট ভাইয়েরা মিষ্টি খাওয়ালো প্রিয় দাদাসহ আমাদেরকে। সবাই বললাম আমরা করোনাকে হারিয়ে নিজেরা জয়লাভ করেছি। আল্লাহ পাক বড়ই মহান(তিনি রহমানির রহিম)।
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম। আমি আপন মানুষ টাকে আরো চিনলাম। গোটা পরিবার টি হয়তো আমার কারনে করোনা আক্রান্ত হতে পারতো। ঐ বাড়িটিতে মিল্টন দার ছোট মাসুম বাচ্চাটা, তাকে অসুস্থ হওয়ার আগের দিন আদর করেছি। আল্লাহ! বড় ক্ষতি হতে পারতো।
আমাকে নিজের সন্তানের মতন করে যে ভালোবাসা দিলেন তারা সবাই,মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত মনে রাখবো। আমি এমন উদর মনের মানুষ ও পরিবার দুইটা আজও চোঁখে দেখিনি।
মহামারি করোনা আমাকে চিনিয়ে দিলো কে আপন! কে পর!!! দাদা ও আমার মাতৃতুল্য দিদি,সুমন ভাই এবং পরিবারের সকলকে আমি হৃদয় থেকে ভালোবাসা জানাই। দাদা আপনার মতন একজন উদর,সহজ,সরল বড় মনের মানুষকে আওয়ামী রাজনীতি এবং এই স্বার্থপর দুনিয়ায় বড়ই দরকার। আপনার তুলনা শুধুই আপনি।
সাবেক ছাত্রলীগনেতা বড় ভাই সুমন ভাই নিজের কথা ভুলে ও ইব্রাহিম -তারাও যে সেবা করেছেন পরিবারটির সাথে মিলে তা আজীবন মনে রাখবো। সুমন ভাই আপনার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা। ষড়াব ঁ ার.
সব মিলিয়ে আমার জন্য-যা দাদার পরিবার করলো। তা কোন ধনী পরিবারও করবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। দাদা, মাতৃতুল্য দিদি, মেঝ দা, বড় বোন মেঝদি, ছোট দা, ছোট দি, বড় ভাই সুমন ভাই, ছোট বউদি,আব্বাজান রুদ্র, ছোট বাবা রাতুল, বিয়াই হেমন্ত, স্নেহের ছোট ভাই ইব্রাহীমসহ সবার প্রতি আমার সম্মান রইলো।
আসলে সমাজে দিলীপ হালদার দাদার পরিবারের মতন পরিবার বড়ই অভাব। এমন মানুষ সমাজে বড়ই প্রয়োজন।