অন্ধ দ্বীপে আলোর প্রদীপ জ্বালানোর গল্প

প্রকাশঃ ২০২০-০৩-০৫ - ১৬:৩৪

আজগর হোসেন ছাব্বির, দাকোপ : দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতায় প্রতিকুলতার মাঝে কোমলমতি শিশুরা যখন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, ঠিক তখন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন ওরা ১৯ জন। এ যেন অন্ধ দ্বীপে আলোর প্রদীপ জ্বালানোর গল্প।
খুলনার উপকুলিয় উপজেলা দাকোপ পরিচিত প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রবন এলাকা হিসাবে। ২০০৭ সাল থেকে এ উপজেলায় ধারাবাহিকভাবে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় সীডর, আইলা, ফনীর মত প্রাকৃতিক দূর্যোগ। এর মধ্যে আইলার তান্ডবে লন্ডভন্ড উপজেলার দু’টি ইউনিয়ন দীর্ঘ ২১ মাস ডুবে ছিলে পানির নীচে। সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সাথে ধবংস হয়ে যায় এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। তারই একটি উপজেলার সর্ব বৃহৎ সুতারখালী ইউনিয়ন। চারিপাশে বৃহৎ নদী বেষ্টিত ইউনিয়নের মানচিত্র প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে অব্যহত নদী ভাঙনের কারনে। আইলার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও আজো গড়ে ওঠেনি এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। সুন্দরবনের কোল ঘেষা সুতারখালী ইউনিয়নের ৯ নং কালাবগী ওয়ার্ডের একটি বড় অংশ মুল ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন। বনবিভাগের কালাবগী ষ্টেশনের অপর পাড়ে এ ওয়ার্ডের প্রায় শতভাগ মানুষ বেড়ীবাঁধের উপর বসবাস করে। ভাঙনের ভয়াবহতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এই ওয়ার্ডের ৮০ ভাগ এলাকাকে বাইরে রেখে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ দিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে বলা যায় কালাবগী ৯ নং ওয়ার্ডটি এখন ইউনিয়নের মুল ভূখন্ডের বাইরে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এই দ্বীপের বাসিন্দারা বাসের তৈরী স্যাকো অথবা নৌকা যোগে ইউনিয়নের মুল অংশে আসতে বাধ্য হয়। অনুন্নত এই ওয়ার্ডে শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে আছে পন্ডিত চন্দ্র সরকারী বিদ্যালয়। ভাঙনের কারনে বার বার স্থানান্তরিত হওয়া স্কুলটি বর্তমানে ওয়ার্ডের শেষ মাথায় বাজার সংলগ্ন এলাকায়। যে কারনে এখানকার বৃহৎ জনগোষ্টির কোমলমতি শিশুরা নদী পার হয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাতায়াতে বাধ্য হয়। এমন প্রতিকুল পরিবেশে অধিকাংশ পরিবারের শিশু সন্তানেরা ধীরে ধীরে স্কুল বিমুখ হয়ে অসময়ে ঝরে পড়ে। বিষয়টি সকলের চোখের সামনে অথচ এই শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ধরে রাখতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা যেন উদাসীন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা উপজেলা প্রশাসন যখন এই দ্বীপের শিশুদের দায়িত্ব নিতে অক্ষম তখন অন্ধ এই দ্বীপে প্রাথমিক শিক্ষার আলোর প্রদীপ জ্বালাতে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন ওরা ১৯ জন। “শিশুদের জন্য আমরা” নামের একটি অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ১৯ যুবক সমাজের প্রতি দ্বায়বদ্ধতার উজ্জল দৃষ্টান্তে স্থাপন করেছে “আমাদের স্কুল” নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে বিদ্যালয়ের ঘর নির্মান, শিক্ষক নিয়োগ, পাঠদান সবই চলছে এখন তাদের তত্ত্বাবধানে। প্রথম শ্রেনী থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত নিয়মিত ক্লাসে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ জন। ১৩ জানুয়ারী ২০১৯ স্কুলটি আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। কথা হয় সেখানকার কয়েকজন অভিবাবক মোক্তার মোড়ল, দাউদ সরদার, আইয়ুব আলী মোল্যা, নুরজাহান বেগম, রোকেয়া বেগমের সাথে। তারা সকলেই বলেন শিশুদের জন্য আমরা সংগঠন আমাদের জন্য পাওয়া এক বিশেষ উপহার। এই প্রচেষ্টা না হলে আমাদের সন্তানেরা কোন ভাবেই লেখাপড়ার সুযোগ পেতনা। এলাকার অধিকাংশ অশিক্ষিত যুবকের উদহারন তুলে ধরে বলেন, যদি আরো আগে এমন উদ্যোগ নেওয়া হত তাহলে হয়ত এদের অনেকেই আজ শিক্ষিত হতে পারতো। স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং সংগঠনের কর্মকান্ড নিয়ে জানতে চাইলে শিশুদের জন্য আমরা সংগঠনের সভাপতি বেলাল হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ফারুক বলেন, আমরা কয়েকজন বন্ধু ফেইজবুকে তথ্য আদান প্রদানে ভাল কিছু করার প্রবল ইচ্ছে থেকে ১২ জুন ২০১৬ শিশুদের জন্য আমরা সংগঠনের আত্নপ্রকাশ। বর্তমানে সংগঠনে ১৯ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটিসহ আছে একটি উপদেষ্টা কমিটি। তারা জানায় “আমাদের স্কুল” নামের এই স্কুলটি সরকার অনুমোদীত না হওয়ায় এখানকার সকল শিক্ষার্থী পন্ডিত চন্দ্র সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থী। আমরা তাদের সারা বছর পাঠদানের পর প্রি টেস্ট পরীক্ষা নিয়ে থাকি। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষা তারা ওই স্কুলেই দিয়ে থাকে। আমাদের উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করা। অর্থের যোগান বিষয়ে তারা জানায়, টাকার জন্য কোন ভাল কাজ আটকে থাকেনা এই বিশ্বাস থেকে সাহস নিয়ে শুরু করা। সংগঠনের সকল সদস্যের নিয়মিত অর্থদান, উপদেষ্টাদের সহায়তা, সর্বপরী দেশে এবং দেশের বাইরে আমাদের কিছু শুভাকাংখি আছে। যারা কিনা প্রতিনিয়ত আমাদের কার্যক্রমে সাহস উৎসাহ এবং সকল ধরনের সহযোগীতা করে থাকে। সেখানকার শিক্ষিকা আম্বিয়া খাতুন বলেন, সীমিত সামার্থের মাঝে শিশু বান্ধব আনন্দঘন পরিবেশে আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহন করছে। আগামী বার্ষিক পরীক্ষায় এই শিক্ষার্থীদের ভাল ফলাফলের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। কেবল স্কুল প্রতিষ্ঠা নয়, অরাজনৈতিক অসাম্প্রদায়িক এই সংগঠন শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে জনকল্যানে কাজ করে আসছে। সকল ঈদ ও পুজায় শিশু এবং অসহায় বয়স্কদের জন্য নতুন জামাকাপড়, ইফতার এবং ঈদে সেমাই চিনি বিতরন, শীতবস্ত্র বিতরন, কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও পুরুস্কার দেওয়াসহ জনহিতকর অনেক কাজের সাথে তারা সম্পৃক্ত। তবে ব্যতিক্রমী এই সংগঠন কোন রাজনৈতিক অথবা নির্বাচনী উচ্চাকাংখার স্বেচ্ছাদান গ্রহন করেনা বলে জানা যায়। সরকারী বেসরকারী পৃষ্টপোষকতা এই সংগঠনের কর্ম তৎপরতায় আরো বেশী উৎসাহ এবং জনকল্যান মূলক কাজকে এগিয়ে নিতে পারে এমন মন্তব্য সচেতন মহলের।