জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগ ঝুঁকিতে কয়রার মানুষ

প্রকাশঃ ২০১৮-০১-০৩ - ১৪:০০

ইমতিয়াজ উদ্দিন, কয়রা : জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের কারনে উপকূলীয় অঞ্চল কয়রা উপজেলার মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। উপজেলার নদী ও খাল, বিল, জলাশয় ক্রমশ লবণাক্ত হয়ে আশপাশের জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে কমছে মাছের উৎপাদন। সমুদ্রে পানির উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়রা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে পরিবেশবীদরা মনে করছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে জানা গেছে, উপকূলের নিকটবর্তী হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের যেসব অঞ্চল অধিক ঝুঁকির মধ্যে, তার মধ্যে খুলনার কয়রা অন্যতম। শুষ্ক মৌসুমে সমুদ্র থেকে লবণাক্ত পানি উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে ঢুকে পড়ছে। নদী সংলগ্ন খাল দিয়ে লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে প্রবেশ করছে। এতে প্রতি বছর বিস্তীর্ণ এলাকা অনাবাদি হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার কারণে এসব জমি স্থায়ীভাবে অনাবাদী হতে চলেছে। ২০০৯ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে কিছু কিছু অঞ্চলে ফসলি জমি ও নদীর পানিতে লবণাক্ততা দেখা দেয় এবং দিন দিন এর পরিধি বাড়তে থাকে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে রিভার্স অসমোসিসের ফলে উদ্ভিদ পানি গ্রহণ করতে না পারায় মরে যায়। এতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। উপজেলার ৩নং কয়রা গ্রামের কৃষক জসিম জানান, জমিতে লোনা পানি ঢুকে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ১০ বছর আগে এমন হতো না। উত্তর বেদকাশি গ্রামের কৃষক রেয়াছাদ বলেন, ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক সার বেশি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত কৃষি জমির মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন করতে কৃষকরা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করছে। এতে একদিকে যেমন তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। কপোতাক্ষ কলেজের অধ্যাপক আ.ব.ম. আঃ মালেক বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনে বর্ষাকালেও বৃষ্টিপাত কমে গেছে। এ কারণে পাট, আমন চাষাবাদে, এমনকি আউশ ধান চাষেও কৃত্রিম সেচের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যা তিনি বিগত ১ যুগ আগে কখনও দেখেননি। অনেক সময় বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার পানিতে ফসলের মাঠ তলিয়ে যাচ্ছে। উষ্ণায়নের ফলে শীত দেরিতে আসায় রবি শস্যের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় উপজেলায় পানি সঙ্কট দেখা দেয়। উপজেলার একসময়ের খর¯্রােতা বিভিন্ন নদ-নদীতে চর জেগে উঠেছে। যার জন্য পানি সরবরাহ পথ বিঘœ হচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসার এস এম মিজান মাহমুদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপজেলায় কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। তবে লবণ সহনীয় ধান উৎপাদনে এ বছর স্থানীয় কৃষকরা ভাল ফলন উৎপাদন করতে পেরেছে। এক সময় নদীতে মানুষের চলাচল ছিল। নৌপথ অকার্যকর হয়ে পড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বেকার হয়ে পড়েছে অসংখ্য লোক। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়েছে। সিডর ও আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রাণহানি ছাড়াও উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টির অভাবে বিগত বছরগুলোয় ডিম ছাড়ার মৌসুমে খাল-বিলে পানি না থাকায় বিভিন্ন দেশি প্রজাতির মাছ বংশ বিস্তার ঘটাতে পারেনি। ফলে এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে অন্তত ৪১ প্রজাতির দেশীয় মাছ। বাকি প্রজাতিগুলোও পড়েছে চরম সঙ্কটে। ফলে মাছের উৎপাদন কমায় বেকার হয়ে পড়েছেন জেলেরা। কয়রার স্থানীয় এলাকবাসীরা জানান, আগে নদী, খাল, বিল ও বিভিন্ন উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন অনেক মাছ পাওয়া যায় না। গত ১০ বছরে টেংরা, শোয়াল, কই, টেংরা, মাগুর, বোয়াল, পাবদাসহ অন্তত ১০ প্রকার দেশীয় মাছের উৎপাদন কমে গেছে। ফলে অনেকে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের সব জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৎস্য চাষের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। কয়রা তার ব্যতিক্রম নয়। মিঠা পানিতে যেসব মাছ ভালো হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সেই পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেলে মাছের ক্ষতি হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।